জকিগঞ্জ প্রতিনিধি : একাত্তরের পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত জকিগঞ্জের এসনু বেগম মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়েছেন। সোমবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় দেশের ৪১ বীরঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা মর্যাদা দিয়ে প্রকাশিত গেজেটে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের এসনু বেগমের নাম অর্ন্তভূক্ত হয়েছে।

৩টি তালিকার প্রথম তালিকার ছয় নম্বরেই রয়েছে তার নাম। মুক্তিযোদ্ধা এসনু বেগমের জীর্ণশীর্ণ ঘর, দরজা জানালা ভাঙ্গা, ভাঙ্গাচোরা বাঁশের বেড়া, ঘরের ভিতর একটি কাঠের চৌকিতে অগোছালো বিছানা। এরই মাঝে তাঁর বসবাস বাবা ১৬ বছরপূর্বে আর মা ১০ বৎসর পূর্বে মারা যান। ছেলে মেয়ে কেউ নেই। আত্মীয় বলতে আছেন দুই বোন। এখনো লজ্জায় মূখ লুকিয়ে রাখেন। বৃদ্ধ বয়সেও শীতলপাটি ও বাঁশ দিয়ে ডাম, চাটাই ইত্যাদি তৈরী করে দিনে দু’মূটো ভাত যোগান। অভাব পিছু না ছাড়লেও কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবার সংসারে তিনি ছিলেন একা। দুই বোন লেবু বিবি ও লেচু বিবির বিয়ে হয়ে গেছে। প্রাইমারীর গন্ডি পাড়ি দিতে পারেননি। যুদ্ধ শুরুর আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন এসনু। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৩/১৪ বছরের কিশোরী। শুধু তার গ্রাম নয় আশপাশ গ্রামে তার মতো সুন্দরী কমই ছিল।

পাকিস্তানী হানাদার বাহীনির লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার উপর। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন গভীর রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তার বাড়ীতে হানাদেয় পাকবাহিনী। চোখমূখ বেঁধে নিয়ে যায় শাহগলী বাজারস্থ পাকিস্থানী বাহিনীর ক্যাম্পে। চলে অমানবিক নির্যাতন। চার দিন ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় তারা। একাত্তরের বীরাঙ্গনা এসনু বেগম সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়ায়।

জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের মনতইল গ্রামের ময়গুন বেগম ও রিয়াছদ আলীর মেয়ে এসনু বেগমের বয়স এখন প্রায় ৫৮। দেশ স্বাধীন হওয়ায় ৪৪ বছর হয়ে গেলেও কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। সম্প্রতি সময়ে সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তিনি বলেন, তার ছবি, নাম ঠিকানা ও ঘটনার বর্ণনা নিয়ে দৈনিক একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সরকারের দৃষ্ঠিগোচর হয়। আমার এ স্বীকৃতির জন্য সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এখন তাঁর ইজ্জতের গ্লানি কিছুটা হলেও মোচন হবে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীণতার তিন দশক পেরিয়ে গেলেও তার কাছে আসেননি কেউ কোন খোঁজখবরও নেন নি। ।

একাত্তরের সেই পৈশাচিক কাহিনীর কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, যুদ্ধের সময় আমি ছোট। দুই বোনের বিয়া অইগেলে আমি আছলাম একলা। একদিন মাজরাইতে কয়জন রাজাকার বন্দুক ও পোষাকওয়ালা পাকিস্থানী সিপাহী নিয়া আমরার বাড়ীঘর ঘেরাও করিয়া মা-বাবার সামনে আমার চোখ বান্দিয়া ফেলে। পরে জোরে ধরিয়া তাদের ক্যাম্পে লইয়া যায়। বলতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। পাকিস্তানী ক্যাম্পে নিয়ে অফিসাররা তাকে পালাক্রমে পৈশাচিক নির্যাতন করে। এভাবেই চলে চার দিন। তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও সেই অভিশাপের ছাপ এখনো তার পিছু ছাড়েনি।

এসনু বেগম বলেন, বাড়িতে আসার পর লোকজনের সামনে বাহির হতে পারতাম না। মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। লোকজনের মুখে কত অশালীন কথা শুনতে হয়েছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে করতে রাজী হয়নি।

যুদ্ধের কয়েক বছর পর বাধ্য হয়ে বাবা-মা গ্রামের বিবাহিত বয়োবৃদ্ধ জমির আলীর সাথে বিবাহ দেন। পরপর দু’টি ছেলে সন্তান জন্ম নিলেও জন্মের পরপরই মারা যায়। এক পর্যায়ে স্বামীকেও হারান তিনি। এবার আশ্রয় হয় পিতা-মাতার ছোট্ট ভিটায়। খেয়ে না খেয়ে কাটছে তার একার সংসার। জীবন সায়ান্নে এসেও এই পৈশাচিকতার বিচার চান তিনি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী খলিল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজাকারের সহযোগীতায় তাকে ধরে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করে পাক বাহিনীর সদস্যরা। বীরাঙ্গনা এসনু বেগম দুঃখ কষ্টের মাঝেও কারো কাছে মাথা নত করেনি। শেষ বয়সে এসে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অবশেষে সরকার তাকে সম্মান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। এসনু বেগমেকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি প্রদান করায় তিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

(এসপি/এএস/অক্টোবর ১৫, ২০১৫)