।মাহবুব আলম।


জীবন কার নাম? এই প্রশ্নের উত্তর কি কারো কাছে আছে? কোথাও কি পাওয়া যাবে এর উত্তর? যুগে যুগে এই প্রশ্নের উত্তর কোথাও মিলে না। মিলবে না। পীযূষ সিকদারও তার উপন্যাসের কোনো একটি জায়গাতে এই প্রশ্নটি করেছেন। প্রশ্ন করে আবার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেটা ঠিক আগের দিনের প-িত মশাইদের মতো জোর করে উত্তর বুঝিয়ে দেওয়া নয়। গল্পে গল্পে, কথার পর কথার মালা গেঁথে জানিয়ে দেওয়া। উত্তর কি মেলে? হ্যাঁ। গভীর মনোযোগের পাঠ-পরিক্রমায় শেষ পর্যন্ত পাঠক এর উত্তরও পেয়ে যান।

আশ্বিস মাসে দেবী দুর্গা তার আগমনী বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। জগৎ সংসারে দেবী তার সন্তানদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেন। ‘জীবনের গল্প’ জীবনালেখ্যখানিতে ঔপন্যাসিক পীযূষ সিকদার তার উপন্যাসের শুরুতেই আশ্বিন মাসে দুর্গার আগমনী বার্তা দিয়ে শুরু করেছেন। তার এই শুরুর কাহিনির সাথে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন জীবনের জন্মকে। উপন্যাসের নায়ক জীবনও এমনি এক আশ্বিন মাসে প্রকৃতিকে জানান দিয়ে তার মা শোভা রানী দেবনাথের কোলের অলংকাররূপে পৃথিবীতে পদার্পন করে।

জীবন উপন্যাসের মূল চরিত্র। সাহিত্যে যে কি না নায়ক। নায়ক বলতে যা বুঝানো হয় বা নায়কের যা যা গুণাগুণ থাকা উচিৎ পীযূষ সিকদারের নায়কও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্য আর দশটা উপন্যাসের নায়কের সাথে পীযূষ সিকদারের নায়কের কোথায় যেন একটু অ-মিল আছে। এই অ-মিলের জায়গাজায়গাটা খুঁজতে গিয়ে নায়কের শরীর থেকে বাঁওড়ের জলের গন্ধ পাই যে কি না তার কৈশোর এবং যৌবনের শুরুটা ধোপাডাঙ্গা গ্রামের পাশের এই বাঁওড়ে আর কুমার নদের জলে দাপাদাপি করে বড় হয়েছে। উপন্যাসে নায়কের বেড়ে ওঠার বর্ণনা খুব অল্প বিস্তর হলেও তার বড় হওয়ার গল্পটাকে খুব সচেতনভাবে এবং যত্নসহকারে ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন। ‘জীবনের গল্প’ উপন্যাসটি তার বন্ধু যশোদা জীবন দেবনাথের জীবনালেখ্য। তার বন্ধুকে নিয়ে লেখা এটি তার প্রথম উপন্যাস, তাও আবার প্রথম খন্ড। উপন্যাসটি এমন একটি জায়গা থেকে আরম্ভ আর শেষটা বিচার করলেই দেখা যাবে অথবা পাঠককুল উপলব্ধি করত পারবেন যে, উপন্যাসটির দ্বিতীয় খন্ড পড়বার আগ্রহ তাদের মনের মধ্যে আরো বেশি করে দানা বাঁধছে।

ঔপন্যাসিক পীযূষ সিকদার ‘জীবনের গল্প’ উপন্যাসটিকে দুটি বৃহৎ ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। একটি ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চল আর অন্যটি রাজধানি ঢাকা। ফরিদপুরের কানাইপুর আর ধোপাডাঙ্গা গ্রাম- গ্রামের বাঁওড়, কুমার নদ, গাছ-গাছালি, পাখি, শিউলি ফুল, কুয়াশা আরো কত কিছু। আর কানাইপুরের চায়ের দোকান। সেখানে নায়ক যশোদা জীবন দেবনাথের বন্ধুদের সাথে আড্ডা অথবা হঠাৎ করে কয়েকটি বিলাশবহুল গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হওয়া। আবার বিশজন বন্ধু মিলে বিশ কাপ চা খেয়ে এই দোকানদার রঘুকে বিশ হাজার টাকা সহযোগিতা করা বা সেখানে কখনো বাউল বাবুল খানের মধুর সুরে আড্ডায় মাতোয়ারা হওয়ার ঘটনাগুলোকে কত সুন্দর করেই না দৃশ্য কল্পে চিত্রিত করেছেন। আমরা পাঠক লেখাগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই- মিশে যাই উপন্যাসের কোনো এক চরিত্রে। কখনো জীবনের মাঝে খুঁজে পাই নিজেকে আবার কখনো বা তার বন্ধুদের মাঝে। ছোটবেলা থেকে জীবনের যে কষ্ট-লড়াই-সংগ্রাম করে বড় হওয়া আর তার যে চিত্ত শিহরীত বর্ণনা সেখানে সবারই জীবন যেন জীবনের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। সবাই একবারের জন্য জীবন হয়ে উঠি। বোধ করি, এখানেই উপন্যাসের চরিত্র বয়ান ও বুননের সার্থকতা।

উপন্যাসের আরো একটি ঘটনাস্থল ঢাকা শহর। সেখানে নায়কের আরেক রকম করে জীবন হয়ে ওঠার বর্ণনা আমাদেরকে যেন কল্পনার জগৎ দেখিয়ে দেয়। নায়ক তো যে কেউ হতে পারে না অথবা সবাই যদি নায়ক হয়েও থাকি তবে তা কোনো এক কলম শিল্পীর হাত দিয়েই স্থান পায় সাহিত্যভান্ডারে। ঔপন্যাসিক তার নায়কের ঢাকার জীবনের যে লড়াই বা বড় হওয়ার যে কষ্টের বর্ণনা করেছেন তা তার নায়ককে আরো বেশি নায়কোচিত করে তোলে। কিন্তু বিস্মিত হই তার বর্ণনায় আর উপন্যাসের এক পাতায় সত্য প্রকাশে। ঔপন্যাসিক অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করে গেছেন যে, তার জারি জুরি বাদ দিলে এটি জীবন দেবনাথের প্রকৃত ঘটনা। কলম শিল্পীর এই সততাকে সমীহ করে শুধু এটুকুই বলার থাকে যে, তিনি যেমন করে উপমার মাধ্যমে, কথনো অ-প্রাণকে প্রাণ দিয়ে ঘটনাগুলোকে বিশেষ করে তুলেছেন তাতে তার লেখনীর দূরদর্শিতারই পরিচয় পাওয়া যায়।

নায়কের ছোট ভাই সুদর্শন দেবনাথের চরিত্র যেন আরেকটি নায়কের গন্ধ ছড়ায়। আলো ঝলমলে এক ক্ষণজন্মা নায়ক সে। তার আদর্শ, শিক্ষা সবকিছুই মনে রাখবার মতো বা মনে গেঁথে যাওয়ার মতো। ঔপন্যাসিক পীযূষ সিকদার শুধু সুদর্শন দেবনাথের চরিত্রই নয় তিনি তার পিতা গোপাল চন্দ্র দেবনাথ বা মা শোভা রানী দেবনাথ অথবা উপন্যাসের একমাত্র দৃশ্যত নায়িকা সোমা দেবনাথকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যেন সবাই বইয়ের পাতা থেকে আত্মার নিকটজন হয়ে ওঠে। সেখানে কারো জন্য হৃদয় কাঁদে, কারো জন্য হৃদয় পোড়ে আবার কারো বর্ণনায় হৃদয় পুলকিত হয়। তার এই চরিত্র রূপায়ন বা গল্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঘটনা বা গল্পগুলো ঘুরে ফিরে কয়েকবার করে ফিরে এসছে। এই যে ৎবঢ়বঃরঃরড়হ ড়ভ হধৎৎধঃরড়হ তারও যেন প্রয়োজনীয়তা উপন্যাসে অনস্বীকার্য। তারও এক ধরনের সৌন্দর্য আছে যা বেলী ফুলের মালার আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা সফেদ চিকন সুতার মতো। ফুলগুলো একসাথে করে মালা বাঁধতে হবে তো!

‘জীবনের গল্প’ জীবনালেখ্যখানি উপন্যাসের গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে লেখা ঔপন্যাসিকের এটি প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। সর্বোপরি সামান্য কিছু ত্রুটি বাদ দিয়ে পড়লে ‘জীবনের গল্প’ জীবনালেখ্যখানি একটি অসাধারণ উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিক পীযূষ সিকদারের ভবিষৎ লেখনীর দ্বার উম্মোচিত হলো আশ্বিনের সকালে কুয়াশার চাদর ভেদ করে প্রথম সূর্যের মতো।

(ওএস/অ/অক্টোবর ১৯, ২০১৫)