বাগেরহাট  প্রতিনিধি : শুটকি মৌসুম শুরুতে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সুন্দরবনের দুবলাসহ ১৪টি চরে বন বিভাগের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সাগরে যেতে পারছে না ১০ হাজার জেলে। গভীর সাগর থেকে মাছ আহরণে কোন ধরণের বাধা নিষেধ না থাকলেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নদী পথ দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে।

সুন্দরবনের পশুর ও শিবসা নদী দিয়ে সকল ধরণের ট্রলার চলাচল বন্ধ থাকায় সাগরে যেতে পারছে না উপকূলী কয়েক হাজার জেলে-মহাজন। অনুমতির অপক্ষোয় শত-শত ট্রলারসহ হাজার- হাজার জেলের মংলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। জেলেরা তাদের পেশাগত ভাগ্য নির্ধারনের ক্ষেত্রে বনবিভাগ বিলম্ব করলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি স্বোচ্ছায় আত্মহতির হুমকি দিয়েছেন জেলেরা তবে বন বিভাগ বলছে বিষয়টি উর্ধতন মহলে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। সিদ্ধান্ত হলেই তাদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগ।

জেলেদের মধ্যে কেউ কেউ সমুদ্রে গিয়েও বনরক্ষীদের তোড়ের মুখে বনসংলগ্ন সমুদ্র চরে ভিড়তে পারছে না, আবার কেউ যাত্রা পথে আটকা পড়েছেন মংলাসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে। এতে বেকারত্বের পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রায় দু’লাখ মৎস্য জীবি-ব্যবসায়ী ও শ্রমিক পরিবার তাদের শত বছরের পুরানো পেশা নিয়ে অজানা শংকার মধ্যে রয়েছেন। অপর দিকে এ খাতে অন্তত দুই কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বনবিভাগ। কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বনবিভাগ আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষুব্ধ জেলেরা। তাদের পেশাগত ভাগ্য নির্ধারনের ক্ষেত্রে বনবিভাগ বিলম্ব করলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি স্বোচ্ছায় আত্মহতির হুমকি দিয়েছেন জেলেরা ।

শুটকী ব্যবসায়ী ও জেলে সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মাৎস্য আহরনকে ঘিরে সুন্দরবন সাগর পাড়ের চর ও দ্বীপাঞ্চলে শুরু শুটকী প্রক্রিয়াকরন মৌসুম। প্রতি বছর অক্টোবর ও শীতের শুরুতেই এ মৌসুমকে সামনে রেখে সমুদ্র যাত্রায় নেমে পড়ে উপকুলের হাজার হাজার জেলে। সুন্দরবনের পশুর নদী দিয়ে জেলেদের সাগরে যেতে দিচ্ছে না বনবিভাগ। আর যেকোন মূল্যে সাগরে যাওয়ার কঠোর মনোভাব নিয়ে কয়েকশ” নৌকা সহ জেলেরা অবস্থান করছে মংলার চিলা খালে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, হয় সাগরে যাবো, না হয় গুলি খেয়ে মরবো। গতকাল মঙ্গলবার মংলার চিলা খালে অবস্থান নেয়া জেলেদের সাথে আলাপ কালে তারা তাদের ক্ষোভের কথা জানান।

সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শহিদ মল্লিক বলেন, যুগ যুগ ধরে ধরে চলে আসা সাগর পাড়ের শুঁটকি ব্যবসা সরকার হঠাৎ করেই বন্ধ করে দিয়েছে। একই সাথে পশুর নদী দিয়েও সাগরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। এতে একদিকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে, অন্যদিকে মানবেতর জীবন যাপন করবে শুঁটকি ব্যবসার উপর নির্ভশীল কয়েক হাজার জেলে পরিবার। ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, খালি হাতে ঘরে ফিরে যাবার কোন যুক্তি নেই। জেলেরা হয় সাগরে যাবে, না হয় তারা প্রশাসনের গুলি খেয়ে মরবে। জেলেরা যে কোন মুহুর্তে তাদের নৌকা বহর নিয়ে সাগরে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারে বলে তিনি জানান ।

বঙ্গোপসাগরের আলোর কোলের শুঁটকি ব্যবসায়ী জালাল আহমেদ বুলবুল জানান, বন বিভাগের সব শর্ত মেনে সরকারী রাজস্ব দিয়ে ব্যবসায়ীরা সাগর পাড়ে ব্যবসা করেন। ৩/৪ মাস আগে থেকেই ব্যাংক বা এনজিওর কাছ থেকে ঋন নিয়ে জাল নৌকা ঠিক করে ব্যবসার প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই বন বিভাগ চরে অবস্থান করে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরনের পাশ বন্ধ করে দেয়ায় চরম আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে কয়েকশ নৌকা ও জেলে সাগরে যাবার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নদীতে অবস্থান করছে। তিনি বলেন, সাগরে যেতে না দিলে এসব জেলেদের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে একই স্থানে অবস্থান করা ৭/৮ শ’ নৌকার সহস্রাধিক জেলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের নৌকার খাবারও শেষ হয়ে যাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার মংলার চিলা খাল ও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মংলার চিলা বাজার যেন শরনার্থী শিবির ! সাগরে যাবার জন্য খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সহস্রাধিক জেলে কয়েকশ” নৌকা সহ চিলা খালে অবস্থান নিয়েছে। সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে চিলা বাজারে অলস সময় কাটাচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাগরে মাছ ধরতে আসা এসব জেলেরা।

এ বিষয়ে বনবিভাগ দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারী দিয়েছে সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নেতারা। সংগঠনটির সভাপতি মোঃ সহিদ মল্লিক আক্ষোপ করে বলেন, দুর্যোগপুর্ন আবহাওয়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বনদস্যুদের উৎপাত আশংকার মধ্যেও জীবন জীবীকার তাগিদে সাগর পাড়ের চরাঞ্চালে রুজি-রুটির জন্য ছুটে থাকে দরিদ্র জেলেরা। আর এ জেলে পল্লীতে জেলেদের ঘর তৈরি ও শুটকী প্রক্রিয়াকরণের এ খাতে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ও করে থাকে সুন্দরবন বন বিভাগের দুবলা টহল ফাঁড়ি। এ বছর বনবিভাগ হঠাৎ বনের নৌপথ ব্যবহারসহ শুটকী প্রক্রিয়াকরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। সংগঠনটির সাধারন সম্পাদক মোঃ শুকুর আলী মীর জানান, সমুদ্রে যাত্রার অপেক্ষায় আটকে রয়েছেন অন্তত ৩৫ হাজার জেলে। সমুদ্রে ভাসমান ও বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে থাকা প্রতিটি নৌকার ফুয়েল খাবার ও শ্রমিক মজুরীতে ব্যয় হচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা।

তিনি জানান, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৫ মাস শুটকী আহরনের মৌসুম । এর মধ্যে একমাস অতিবাহীত করছেন বনবিভাগের পাসপারমিট ও অনুমতির অপেক্ষায়। সমুদ্রগামী বেশির ভাগ জেলেই ব্যাংক লোকসহ বিভিন্ন এনজিও এবং আড়ৎদারদের কাছ থেকে সুদের কিস্তিতে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এ অবস্থায় জেলে পারবার গুলোতে চরম হা-হাকার অবস্থা বিরাজ করছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, অর্থলগ্নির বোঝা মাথায় নিয়ে জেলেদের বাড়ি ফেরার অবস্থা নেই। তাই তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি স্বেচ্ছায় আত্মহতির জন্যও প্রস্তুত জেলেরা।

দুবলার মৎস্য ব্যবসায়ী আঃ হালিম গাজী ও গোলাম রসুল জানান, বনবিভাগের অনুমতি না পেয়ে বাধ্য হয়ে মৎস্যজীবীরা কেউ কেউ বলেশ্বর-বগী-চর দুয়ানী-কচিখালি-দুবলা বিকল্প রুট ব্যবহার করছেন। এতে পূর্বের ১২০-১৫০ কিলোমিটারের স্থলে বর্তমানে দূরত্ব দাঁড়িয়েছে ৬-৭শ’ কিলোমিটার। এ পথে সময়ের ব্যবধান ৪ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ ৮ ঘন্টার স্থলে বর্তমানে এ পথ অতিক্রম করতে ৩২ ঘন্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। যে সব জেলেরা দুবলার চরাঞ্চালে পৌছেছেন তারা একদিকে সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস থেকে জীবন বাঁচাতে জরিমানার ভয়ে জেলেরা চরাঞ্চালে ভিড়তে পারছেন না বলে জানিয়েছেন জেলেরা। এতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নিরুপায় অনেক জেলেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন।

এ বিষয়ে দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান (অবঃ) মেজর জিয়া উদ্দিন জানান, মৎস্যজীবীরা কখনো বণ্যপ্রাণি শিকার করে না। কারণ বন ও সমুদ্র সম্পদের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভর। জেলেদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা না করে হঠাৎ চলাচলের এ পথ বন্ধ করে দেয়া আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।

তিনি আরও বলেন, সমুদ্রগামী জেলেরা বনের অভ্যন্তরে মাছ শিকার করে না। জেলেরা সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ শুটকী প্রক্রিয়া করার জন্য সাগরপাড়ের বালু চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে, বনের ভেতর নয়। এ ক্ষেত্রে বনসুরক্ষা করেই সমুদ্রগামী জেলেদের পশুর নদী দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী। তিনি আরও বলেন, সমুদ্রে দেশীয় জলসীমায় এ দেশীয় জেলেদের অনুপস্থিতিতে ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশে সমূহের জেলেরা কোটি কোটি টাকা সমমূল্যের মৎস্য সম্পদ অবাধে লুটে নেয়ার সুযোগ পাবে।

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক ড. সুনীল কুমার কুন্ডু জানান, সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে জেলেদের বাঁধা নেই। তবে দুবলার চর বন এলাকা হওয়ায় সেখানে মাছ ধরা ও বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর সুন্দরবনের পশুর নৌ রুট দিয়ে জেলেদের যাতায়াতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেলে এ রুটের অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়।

(একে/এএস/নভেম্বর ০৩, ২০১৫)