আনিসুর রহমান আলিফ


এ জগতে মানুষের যে কতো রকমের শখ আছে তা এত অল্প সময়ে বলে কী শেষ করা যাবে? শখ বড় শৌখিন জিনিস। মানুষ ধনি হোক অথবা গরিব, শখের ব্যাপারটা কিন্তু সকলের ক্ষেত্রেই সমান। কারো শখ বড়, কারো ছোট কিন্তু শখ সকলেরই থাকা চাই। কোটি মানুষের কোটি রকমের শখের মধ্যে আমার অতি পরিচিত আসাদ ভাইয়ের মাছ ধরার শখটা কিন্তু এক রকমের নেশার পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে।

সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার এলেই মনে-মনে তিনি ভীষণ রকমের এক উত্তেজনা অনুভব করেন। আসাদ ভাই জেলা শিক্ষা অফিসের মাঝারি গোছের একজন কর্মচারী। সপ্তাহের শেষ দিন, মানে বৃহস্পতিবারে কোনো ভাবেই তিনি অফিসে মন বসাতে পারেন না। হেড ক্লার্ক সাহেব, মানে বড় বাবু আসাদ ভাইয়ের শখের ব্যাপারটা জানেন। তাইতো দুপুরের দিকে সবাই যখন একসাথে বসে লাঞ্চ করে, ওদিকে তখনও আসাদ ভাই টেবিলে ফাইল পত্র নারাচারা করেন। আসাদ ভাইয়ের দিকে ইশারা করে বড় বাবু অন্যদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
-দেখুন পাগলটার কা-। আসাদ ভাইয়ের রুমের দিকে তাকিয়ে সবাই একযোগে হেসে উঠে বলে,
-যেহেতু আসাদ ভাই আজ লাঞ্চ আনেননি সেহেতু নির্ঘাত আজ বৃহস্পতিবার। যাক বাবা কাল ছুটি। সহকর্মীদের এমন কথায় হা-হা, হি-হি আর হো-হো শব্দে লাঞ্চ রুমটা একেবারে গম গম করে ওঠে।
সকলের লাঞ্চ করা হয়ে গেলে আসাদ ভাই তার টেবিলের উপর থাকা ফাইল পত্রগুলো আলমারিতে তুলে রেখে রুমের দরজাটা প্রায় নিঃশব্দে বন্ধ করে আলতো পায়ে বড় বাবুর রুমের সামনে চলে আসেন। বড় বাবু আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে ঘার কাত করে সম্মতি দিতে দেরি আছে আসাদ ভাইয়ের দোতলা থেকে নীচতলায় নামতে দেরি নেই। ডানে-বামে কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা অফিস কম্পাউন্ডের বাইরে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। চটজলদি একটা রিকশা ধরে সোজা চলে যান বড় বাজারের দিকে। বড় বাজারে আসাদ ভাইয়ের চেনা দোকান আছে। মাছ ধরার সকল সরঞ্জাম-ই সেখানে পাওয়া যায়। একেক ধরনের মাছ ধরতে একেক ধরনের টোপ। আসাদ ভাইয়ের বোয়াল মাছ ধরার বেশ লোভ আছে। কিন্তু বোয়াল মাছ সব সময় সব জায়গায় পাওয়া যায় না। তাই বোয়ালের টোপের পাশাপাশি তিনি কাতলা ধরার টোপও সংগ্রহ করেন।

আশ্বিন মাস। ফেলে আসা বর্ষার পানিতে খাল, বিল, পুকুর, দিঘি এখনও কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। নতুন পানির ঘোলা দাগ কেটে গিয়ে জলাশয়গুলো এখন কাচের মতোই স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। এমন পানিতে মাছেরা মনের সুখে দল বেঁধে জলের উপরিভাগে বিচরণ করে বেড়ায়। এই সময় উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা বঁড়শিতে আটা ঝুলিয়ে তেলাপিয়া মাছ ধরে। আসাদ ভাই অবশ্য দিনের বেলা মাছ ধরেন না। তিনি বের হন রাতে। রাত যতটাই নিশি হয় মাছেদের খুধাও ততটাই বেড়ে যায়। ভাদ্র থেকে আশ্বিন এই দুটি মাসে আবহাওয়া বেশ বৈরী থাকে। কখনও বৃষ্টি ভেজা রাত কখনও পূর্ণিমার পরিষ্কার আলো। যে রাতে গরমটা একটু বেশি পড়ে সে রাতে মাছেদের চলাচল বেড়ে যায়। খাবারের সন্ধানে তারা জলাশয়ের প্রতিটি কোনায় কোনায় ঘুরে বেড়ায়।

আসাদ ভাই মনে মনে আজ বেজায় খুশি। খুশির কারণ আজ যে শুধু বৃহস্পতি বার তার জন্য নয়, আজ পূর্ণ পূর্ণিমা। এমন রাত আশ্বিন মাসে পাওয়াটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।
আসাদ ভাইকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই মতিন একগাল হেসে বললো,
-আরে আজ যে বৃহস্পতিবার। আসাদ ভাইও একটু হেসে বললেন,
-হ্যাঁ, আজ বৃহস্পতিবার। হাতে মোটেই সময় নেই। চট জলদি জিনিসগুলো মেপে একটা ব্যাগে পুড়ে দাও।
আসাদ ভাইয়ের রেসিপি অনুযায়ী মতিন টোপ বানানোর উপাদানগুলো মেপে-মেপে ব্যাগে ভরে দিয়ে বললো,
-বড় মাছ পাইলে জানায়েন।
-আচ্ছা জানাবো। বলে আসাদ ভাই বাড়ির পথ ধরলেন।
আসাদ ভাইয়ের বাড়ি শহরের মধ্যেই। বাড়ি থেকে বাজার আর অফিস দু’টোর দুরত্বই এক। রিকশায় গেলে বিশ মিনিট হেঁটে আধ ঘণ্টা। আসাদ ভাই যখন বাড়ি ফিরলেন তখন প্রায় চারটা বেজে গেছে। সাধারণ ভাবেই তিনি বৃহস্পতিবারে অফিসে লাঞ্চ করেন না। একটু দেরি হলেও বাড়ি ফিরে সুন্দর করে গোসল সেরে পেট ভরে খাওয়া দাওয়া করেন। আসাদ ভাইয়ের স্ত্রী মিনা ভাবি। আসাদ ভাইয়ের এই শখের ব্যাপারটা বিয়ের পর থেকেই জানেন। তার হিসাবে, পুরুষ মানুষের তো কতো ধরনেরই আজে-বাজে শখ থাকে। মাছ ধরা কি-ই-বা দোষের? তাই এই ব্যাপারটায় তিনি তেমন কোনো আপত্তি করেন না।
বাড়ি ফিরেই শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে আসাদ ভাই বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। সাবান মেখে ভালো করে গোসল সারলেন। ইতোমধ্যে টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে গেছে। খেতে খেতে মিনা ভাবিকে বললেন,
-আজকের রাতটা খুব সৌভাগ্যের বুঝলে। আজ পূর্ণিমা। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা যদি মেঘের আড়াল পেরিয়ে একবার জলের উপর এসে পড়ে তাহলে আর যায় কোথায়।
মিনা ভাবি কাতলা মাছের মাথাটা আসাদ ভাইয়ের পাতে তুলে দিয়ে বললেন,
-ধুত তোমার এই কাতল মাছ কুটতে আমার আর ভালো লাগে না।
-আরে সেই জন্যেই তো বলছি। আজ বড় সৌভাগ্যের রাত। এমন রাতে যারা নেহাত বোকা তারাই কাতল মাছ ধরবে। আজ ধরবো বোয়াল।

খাওয়া শেষ করে মতিন এর দোকান থেকে আনা প্যাকেটটা নিয়ে আসাদ ভাই বারান্দায় চলে গেলেন। মনের আনন্দে গুন-গুন করে অজানা এক সুর ভাজতে-ভাজতে জোর আসনে মেঝেতে বসে হামাল দিস্তায় উপাদানগুলোকে গুরো করতে লাগলেন। প্রতিটি উপাদান গুরো করা হয়ে গেলে সেগুলোর মধ্যে উৎকট গন্ধের একটি পেস্ট মেশালেন। কী বিশ্রী গন্ধ। শুনেছি এমন বাজে গন্ধই নাকি বঁড়শি গিলতে মাছেদের একবারে কান ধরে টেনে নিয়ে আসে।

টোপ প্রস্তুত হতে-হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে পড়লো। আসাদ ভাই সাধারণত সন্ধ্যার পরেই বের হন। মাছ ধরার ছিপ-টোপ, বসার জন্য পোর্টেবল চেয়ার, ছোট্ট একটা হট-পটে পরাটা আর ডিমের অমলেট, সাথে এক ফ্লাক্স গরম চা। এক কথায় আসাদ ভাইয়ের মাছ ধরার আয়োজনটা বেশ।
মিনা ভাবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে কেরোসিনের লন্ঠনটা ঝুলিয়ে বিসমিল্লাহ্ বলে প্যাডেলে পা চাপলেন আসাদ ভাই। সাইকেল চলছে মাঝারি তালে। আসাদ ভাই মাছ ধরার জন্য সাধারণত একটু দূরে যেতেই পছন্দ করেন। মনে মনে ঠিক করা আছে, আজ যাবেন মিয়া সাহেবদের দিঘিতে। লম্বা দিঘি। জেলেদের জাল বছরে মাত্র দু’একবারই ওখানে পড়ে। মিয়া সাহেবদের দিঘিতে মাছ ধরার জন্য আর কারো অনুমতি থাকুক আর না থাকুক। আসাদ ভাইয়ের জন্য ঢালও অনুমতি আছে। মিয়া সাহেব বলেন,
-চোর ছ্যাঁচরে কতো মাছ ধরে নিয়ে যায়। আপনি হলেন শিক্ষিত মানুষ, আমার দিঘিতে শখ করে মাছ ধরবেন, তার জন্য অনুমতি লাগবে না। আমি খানসামাকে বলে দেবো। মাছ ধরতে আসলে আপনি শুধু তাকে একটু জানিয়ে রাখবেন। ও আপনার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটাও করে দেবে।
সত্যিকারের যারা বড় মানুষ তাদের বুকের পাটাটাও হয় বড়। আসাদ ভাইয়ের কাছে মিয়া সাহেব সেই গোছের একজন মানুষ।

আসাদ ভাইয়ের বাড়ি থেকে মিয়া সাহেবদের বাড়ির দূরত্ব কম না। কচুয়া বাজার পার হয়ে তবে নলি হাটি। পথ প্রায় পনের কিলোমিটার। রাতের বেলা সাইকেল চালিয়ে যেতে ঘণ্টা দুই সময় লাগে। আসাদ ভাই গুন-গুন করে একটা সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে সাইকেল চালাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিবু নিবু আলো জ্বালিয়ে অটো-রিকশা, মোটর সাইকেল তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাতে এমনি করে মাছ ধরতে যাওয়া আসাদ ভাইয়ের কাছে একরকম অভিযানের মতোই লাগে।

কচুয়া বাজারে এসে আসাদ ভাই সাইকেল থেকে নামলেন। চেনা একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে বসে গরম চা খেয়ে, এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা ম্যাচ কিনে আবার সাইকেলে উঠলেন। পথ আর বেশি নেই। কচুয়া থেকে মিয়া সাহেবদের বাড়ির পথটা হেরিং বন্ড দিয়ে গড়া। শিশির ভেজা ইটের উপর দিয়ে সাইকেল চালানো বেশ এক ঝক্কির ব্যাপার। যা হোক ধীরে সুস্থে দেখে শুনে মিয়া বাড়ির কম্পাউন্ডে যখন পৌঁছানো গেলো তখন রাত সারে নয়টা বেজে গেছে। খানসামার ঘরটা মিয়া সাহেবদের পারিবারিক মসজিদের পাশেই। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো, ঘরে তালা ঝুলছে। মানে, খানসামা হয়তো ছুটিতে বাড়ি গেছেন। আসাদ ভাই মাছ ধরার ব্যাপারে এমনিতেই লোকজন পছন্দ করেন না। একা একা মাছ ধরার মতো আনন্দ এই পৃথিবীতে হয়তো আর কোনো কিছুতেই নেই। খানসামা নেই দেখে মনে-মনে তিনি বেশ খুশি হয়ে সাইকেলটাকে ঠেলে দিঘির দিকে এগিয়ে গেলেন। পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্র ইতোমধ্যেই তার মাতাল করা রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। চারিদিকটা কেমন যেন মায়াবী অপার্থিব মনোমুগ্ধকর এক সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে। রাতের এমন দৃশ্য যে কতটা মনোহর তা এমনি করে মাছ ধরতে না এলে বোধকরি বোধগম্য হয় না। আসাদ ভাই দিঘির একেবারে শেষ মাথায় চলে গেলেন। এই দিঘিতে তিনি অনেকবার মাছ ধরতে এসেছেন। দিঘির প্রায় প্রতিটা দিক, প্রতিটা পার তার চেনা। আজ যে দিকটায় তিনি যাচ্ছেন সেটা দিঘির পশ্চিম দিকের একটা অংশ। সাইকেলটাকে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে রেখে এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে লন্ঠন নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন। পরিষ্কার মতো একটা জায়গা বেছে নিয়ে পোর্টেবল চেয়ারটাকে পাতলেন। সামনে দিঘি, পেছনে মেহগনির ঘন বাগান। আসাদ ভাই লন্ঠনের তেজটা একটু বাড়ালেন। ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা শিশি বের করে ক্ষাণিকটা কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিলেন চারিদিকে। পুরোনো জায়গায় সাপ-খোপের একটা উৎপাত সব সময়-ই থাকে। তবে একবার কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিলে আর ভয় থাকে না। ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে দিঘির জলের উপর আলো নিক্ষেপ করে বুঝলেন, এখানে কোনো প্রকার ডালপালা বা জলজ আগাছা নেই। বঁড়শি ফেলার মতো এর থেকে ভালো জায়গা আর হতেই পারে না। মনের আনন্দে আসাদ ভাই ব্যাগ থেকে তার সিপ বের করতে শুরু করলেন। আসাদ ভাইয়ের দুইটা সিপ। দু’টোই আধুনিক সিপ। মাছ যত বড় আর শক্তিশালীই হোক না কেন, একবার টোপ গিলে ফেললে আর রক্ষা নেই। আসাদ ভাই ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে খুব কায়দা করে বঁড়শিতে টোপ পড়ালেন। দক্ষ হাতে দুই তিনটা পাক মেরে টোপটা ছুঁড়ে মারলেন দূরের জলে। টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিলেন শোলার তৈরি জল-টোনের অবস্থান। নজরটা ঐ টোনের উপরেই রাখতে হবে। চাঁদটা ইতোমধ্যে রাতের অতিথি হয়ে তির্যক ভাবে দিঘির জলের উপর গলে গলে পড়েছে। কী মোলায়েম মিষ্টি তার আলো। আসাদ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে নিলেন। আহ্, পূর্ণিমার এমন রাতে একলা দিঘির পারে চা’টা যেন অমৃতের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে অচেনা অজানা অসম্ভব সুন্দর কোনো ভিনগ্রহের কোনায় বসে তিনি চা পান করছেন।

মিয়া সাহেবদের বাড়িটা লোকালয় থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দূরে। দু’এক ঘর পরশী অবশ্য আছে, তবে তারা প্রায় সকলেই প্রজা শ্রোণির। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলেন, কোথাও কোনো আলো নজরে আসছে না। আসাদ ভাইয়ের অবশ্য এমন পরিবেশ-ই পছন্দ। এরই মধ্যে দেখতে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘড়ির ছোট কাঁটাটা বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। এখন পর্যন্ত জল টোনে কোনো সারা পাওয়া যায় নি। তাতে কী? আসাদ ভাই প্রচ- ধৈর্যশীল একজন মানুষ। এর আগে এমনও হয়েছে যে, সারা রাতে একটি বারের জন্যও কোনো মাছ তার বঁড়শিকে স্পর্শ করে নি। মাছ ধরতে না পারলেও এমনি করে একাকী নির্জনে রাত কাটাতেও আসাদ ভাইয়ের আনন্দ। আসাদ ভাই আকাশের দিকে তাকালেন। আহা, চাঁদটাকে ঘিরে তারারা যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। তারাদের মৃদু মিটি মিটি ইশারায় কীসের যেন স্পষ্ট এক আহ্বান। হঠাৎ জলের মধ্যে কেমন যেন একটা আলোড়ন অনুভূত হলো। আসাদ ভাই দ্রুত টর্চ ফেললেন শোলার তৈরি জল-টোনের উপর। কিন্তু কোথায় জল টোন ! দু’টো বঁড়শির একটিরও তো জল-টোন নজরে আসছে না। আসাদ ভাই বুঝলেন, গিলেছে। টোপ গিলেছে। কিন্তু দু’টো সিপ একসাথে ম্যানেজ করা মুশকিলের ব্যাপার তাই একটি সিপকে তিনি পা দিয়ে চেপে রেখে অপর সিপটা ধরে হালকা তালে হুইলটা ঘোরাতে শুরু করলেন। খুব সাধারণ ভাবেই সুতো হুইলে পেঁচিয়ে যাচ্ছে দেখে আসাদ ভাই ভাবলেন ব্যাপার কী? সুতো ছিঁড়ে গেল না কী? এত শক্ত সুতো, এতো সহজে তো ছিঁড়তে পারে না। হঠাৎ হুইলের সুতোয় টান পড়লো। সে কী টান! আসাদ ভাই সুতো ছাড়তে শুরু করলেন। সা-সা শব্দ করে হুইল ঘুরছে। ক্ষাণিক সুতো ছাড়ার পরে আসাদ ভাই আবার হুইল গোটাতে শুরু করলেন। সুতোর টান এবার বেশ বেড়েছে। মাঝে মাঝে সিপটা একেবারে বেঁকে যাচ্ছে। আসাদ ভাই আবার সুতো ছাড়লেন। এভাবে সুতো ছাড়া আর গোটানোর খেলা চললো বেশ। ক্ষাণিক বাদে ওপাশ থেকে একটু যেন বিশ্রাম এলো। আসাদ ভাই আবার হুইল ঘুরিয়ে সুতো গোছাতে শুরু করলেন। এবার টানটা একটু কম অনুভূত হচ্ছে। এতক্ষণে মাছটা নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসাদ ভাইও যে ক্লান্ত হননি তা বলা মিথ্যা। দীর্ঘ দিনের মাছ ধরবার অভ্যাস থাকা সত্যেও আজ তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। আসাদ ভাই খুব কায়দা করে সুতো গোছাচ্ছেন। এইতো প্রায় এসে গেছে।

কিন্তু ওটা কী ! ডাঙার কাছে মাছের মাথাটাকে দেখে আসাদ ভাই চমকে উঠলেন। এতো বিশাল বড় মাছ ! বোয়াল মাছ। আসাদ ভাই বুঝলেন, এই মাছ যদি একবার ক্ষেপে যায় তাহলে তিনি সিপ ধরে রাখতে পারবেন না। তিনি সুতো আর না গুছিয়ে বরং একটু ঠিলে করে দিলেন। এবার একটু পিছিয়ে এসে দিঘির পারে থাকা নারকেল গাছটার সাথে দুটো প্যাঁচ দিয়ে একটা গিঁট বাঁধলেন। সব রকম পরিস্থিতির জন্য সব রকমের ব্যবস্থাই তার কাছে আছে। বারতি সুতো প্যাঁচানোর জন্য ব্যাগ থেকে তিনি গুটি-লাঠিটা বের করলেন। এবার খুব সাবধানে গুটি লাঠির সাথে সুতো প্যাঁচাতে শুরু করলেন। হ্যাঁ আসছে। মাছটা এবার সত্যিই ডাঙায় উঠে আসছে। মনের মধ্যে আসাদ ভাইয়ের ঢং ঢং শব্দে উত্তেজনার ঘণ্টা বাজছে। আসাদ ভাইয়ের জীবনে হয়তো এটাই সবচেয়ে বড় কোনো বোয়াল মাছ ধরার অভিজ্ঞতা হবে। এইতো চলে এসেছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার! মাছটা কিন্তু খুব বেশি ছটফট করছে না। আসাদ ভাই ভাবলেন টোপটা হয়তো তার হৃদপি-ে গেঁথে গেছে। তাই নড়াচড়া করার শক্তি বুঝি সে হারিয়ে ফেলেছে। মাছটা যখন একেবারে ডাঙায় উঠে এলো তখন আসাদ ভাই মাছটার সাইজ দেখে একেবারে ‘থ’ বনে গেলেন। ওটাকে ডাঙায় তুলতে পারবেন কী না একবার ভাবলেন। মুগুরটা আছে হাতের কাছেই। বাড়ি দেবেন ? নাহ থাক। আগে আরো একটু ডাঙায় তুলি তারপর দেখা যাবে। অত বড় মাছকে টেনে তুলতে যেয়ে ঘেমে একেবারে নেয়ে ওঠার মতো অবস্থা হলো। একটি দড়ি খুব সাবধানে মাছটির কানসার মধ্যে ঢুকিয়ে বেশ এঁটে বেঁধে ফেললেন। যাক আর ভয় নেই। ভারী মাছটাকে এবার টেনে নিয়ে নারকেল গাছটার সাথে বেঁধে রাখলেন। বেশ পরিশ্রম হয়েছে। আসাদ ভাই রিতিমতো হাঁপাচ্ছেন। প্রচুর শক্তি ক্ষয়ের ফলে হাত পা কাঁপছে তার। আসাদ ভাই গামছা দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে চেয়ারের কাছে ফিরে এলেন। হঠাৎ মনে পড়লো। আরে! আরো একটা বঁড়শির টোপও তো উধাও। পায়ের কাছে থাকা দ্বিতীয় সিপটা তুলে নিয়ে হুইল ঘোরাতে শুরু করলেন। ক্ষাণিক এভাবে সুতো গোছানোর পরে সুতোয় টান পড়লো। তিনি সুতো ছাড়তে শুরু করলেন। ক্ষাণিক বাদে আবার সুতো গোছাতে শুরু করলেন। এভাবে সুতো টানা আর ছাড়াতে ঘণ্টা খানেক কেটে গেলো। আসাদ ভাই সম্পূর্ণ রূপে হাঁপিয়ে উঠেছেন। ভাবছেন, এই মাছটা হয়তো আগের টার থেকেও বড় হবে। মাছটা যখন প্রায় ডাঙার কাছে উঠে এলো তিনি এগিয়ে গেলেন। এ কী ! প্রকা- একখানা বোয়াল মাছের মাথা। মুখটা ভয়ানক ভাবে হা করে আছে। পূর্ণ পূর্ণিমার ফর্সা আলো মাছটির মুখের উপর পড়ে মুখের মধ্যে থাকা ধারালো দাঁতগুলোর মধ্যে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। আসাদ ভাই ভয় পেলেন। তিনি জানেন ঐ সুচালো দাঁতওয়ালা মুখের মধ্যে যা-ই পড়বে তা-ই কেটে ছিঁড়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আসাদ ভাই ভাবছেন এখন কী করবেন? এগিয়ে যাবেন সামনে ? সাথে কেউ একজন থাকলে বড় ভালো হতো। কিন্তু এই নির্জনে চিৎকার করে ডাকলেও তো কাউকে পাওয়া যাবে না। তিনি বুঝলেন, যা করার তাকে একাই করতে হবে। আসাদ ভাই গামছাটা ছিঁড়ে দুই ভাগ করে দুই হাতে পেঁচিয়ে নিলেন। এগিয়ে গেলেন মাছটির দিকে। কিন্তু মাছটা যেভাবে হা করে আছে তাতে কানসার মধ্যে দড়িটা কী ভাবে ঢোকাবেন তাই ভাবছেন। বিশাল বড় মাছ। লম্বায় ছয়-সাত ফুট তো হবেই। আসাদ ভাই মাছটির আরো কাছে চলে গেলেন। অবস্থা বুঝে এক লাফে ঘোড়ায় চড়ার মতো করে মাছটার উপর চড়ে বসলেন । মাছটা কিন্তু এবার ছটফট করতে শুরু করেছে। আসাদ ভাই দুই হাত দিয়ে শক্ত করে মাছটাকে জাপটে ধরে বসে রইলেন। ক্ষাণিক বাদে একটু বিশ্রাম এলে কানসাটা ফাঁকা করে দড়িটা ঢোকাতে যাবেন ঠিক তখন খেয়াল করলেন, ডাঙার দিক থেকে কেমন যেন বাচ্চা ছেলেদের খিল খিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ব্যাপার কী? কেউ এসেছে না কী?
- কে ? কে ওখানে? বললেন আসাদ ভাই।
কোনো শব্দ এলো না। আসাদ ভাই ভাবলেন মনের ভুল। তিনি আবার দড়িটাকে কানসার মধ্যে ঢোকাতে গেলেন কিন্তু আবার সেই একই কা-। খিল খিল করে হাসির শব্দ। আসাদ ভাই ভাবলেন আগে মাছটাকে বেঁধে তারপর দেখবেন কে ওখানে। দড়িটাকে কানসার মধ্যে ঢোকানোর জন্য যেই তিনি হাত ঢুকিয়েছেন অমনি প্রচ- এক আর্তচিৎকার করে এক লাফ মেরে তিনি ডাঙায় উঠে এলেন।
কামড়ে দিয়েছে! মাছটা তার হাতে কামড় বসিয়েছে। হাতে গামছা প্যাঁচানো ছিলো ঠিকই কিন্তু তার উপর দিয়েই কামড় বসিয়েছে। প্রচ- যন্ত্রণায় আসাদ ভাইয়ের চোখে জল এসে গেলো। গামছার আবরণটা খুলতে গিয়ে বুঝলেন ওটা খোলা অসম্ভব। প্রচ- যন্ত্রণা হচ্ছে। কী করবেন তিনি ? হেঁটে লোকালয়ে গিয়ে কাউকে ডেকে আনবেন ? কিন্তু মাছ দু’টোকে এভাবে রেখে গেলে শেয়াল কুকুরে যদি টেনে নিয়ে যায় ? আসাদ ভাই চেয়ারে বসলেন। কাঁপা হাতে ফ্লাক্সটা ধরে একটু চা ঢেলে নিলেন। চা খাওয়ার পরে শরীরে যেন একটু বল ফিরে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত তিনটা। হঠাৎ পেছন থেকে আবার সেই খিল খিল হাসির শব্দ। আসাদ ভাই টর্চের আলো ফেললেন। কিন্তু নাহ্। মেহগনি বাগানের মধ্যে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় তার ভুল হচ্ছে। এত রাতে বাচ্চা ছেলের হাসির শব্দ আসবে কোথা থেকে? আসাদ ভাই একটা সিগারেট জ্বাললেন। লম্বা একটা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিতে ক্ষাণিকটা ক্লান্তি যেন ধোঁয়ার সাথে বের হয়ে গেলো। সিগারেট শেষ করে আসাদ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। খেয়াল করলেন হাতে পেঁচিয়ে রাখা গামছার একপাশ গলে ক্ষাণিক রক্ত জমাট বেঁধেছে। কতটা কেটেছে কে জানে? থাক বাড়ি ফিরে দেখা যাবে। কিন্তু এখন কী করা যায়। আসাদ ভাই টর্চ নিয়ে দেখতে গেলেন ডাঙায় তোলা মাছটা কী আছে নাকি জলে নেমে চলে গেছে। না। যায়নি। এখনও আছে। হঠাৎ আবার হাসির শব্দ। এবার শব্দটা শোনা গেলো একেবারে পরিষ্কার ভাবে। নাহ্ এতো পরিষ্কার শব্দ তো কোনো ক্রমেই ভ্রম হতে পারে না। আসাদ ভাই টর্চ নিয়ে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে রাখা মাছটার সামনে দিয়ে মেহগনির বাগানের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না কাউকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ আবার হাসির শব্দটা এলো। এবার শব্দ এসেছে দিঘির দিক থেকে। ব্যাপার কী ? আসাদ ভাই দিঘির দিকে ফিরে এলেন। আশ্চর্য ! কোথাও কেউ নেই !
-আ-সা-দ।
হঠাৎ কেমন যেন খনখনে কণ্ঠে টেনে-টেনে কে যেন পেছন থেকে তাকে ডাকলো বলে মনে হলো। কিন্তু কে ডাকবে? আসাদ ভাই চঞ্চল ভাবে টর্চের আলো এদিক-সেদিক ফেলে দেখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথাও কিছু দেখা গেলো না। ক্ষাণিক বাদে শব্দটা আবার এলো।
-আসাদ, আসাদ। বোয়াল মাছ খাবি ? হি হি হি।
কী ভয়াবহ কণ্ঠস্বর! কণ্ঠটা শুনেই আসাদ ভাইয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে কীশের যেন একটা ঢেউ নেমে গেলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে তিনি বললেন,
-কে, কে ওখানে। আ- আ- আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বিজন বনে নিশি কাটানোর অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে। তু- তু- তুমি যেই হও বেরিয়ে এসো। আমার সামনে এসো।
ক্ষাণিক কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। আসাদ ভাই প্যাকেট থেকে আবার একটা সিগারেট বের করে জ্বাললেন। চেয়ারে বসে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হঠাৎ কে যেন তার একেবারে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
-বোয়াল মাছ খাবি? হি হি হি।
-কে কে ? বলে আসাদ ভাই পেছন ফিরে তাকাতেই যা দেখলেন তা যে তিনি কোনোদিন দেখবেন তা ভাবতেও পারেন নি। এ কী দেখছেন তিনি ! ছয় সাত ফুট উচ্চতার একটি বোয়াল মাছ লেজের উপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো পড়ে সারি ধরা দাঁতগুলো ছুরির ফলার মতো চকচক করছে। এ কী দৃশ্য ! আসাদ ভাইয়ের কেমন যেন মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। তিনি চোখ কচলে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তিনি যা দেখছেন তা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনিতেই নীরব একটি জায়গা, তার উপর পরিশ্রমও হয়েছে বেশ। তাই হয়তো এমন টা হচ্ছে। কিন্তু নাহ্। চোখ কচলে তিনি যা দেখলেন তা আরো ভয়াবহ দৃশ্য। দিঘির জল ছেড়ে কুল বেয়ে কী যেন উঠে আসছে তার দিকে। হ্যাঁ মাছই তো। ঐ তো দেখা যাচ্ছে। বোয়াল মাছ। ভয়ানক দাঁত বের করে তারা একযোগে হাসতে শুরু করেছে ! নারিকেল গাছে বেঁধে রাখা বোয়ালটাও কীভাবে যেন দড়ি ছিঁড়ে লেজে ভর করে এগিয়ে আসছে। তিক্ষ্ম দাঁত বের করে মাছটি হা করে হাসতে হাসতে তার দিকেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। এখনি হয়তো মাছটি তার ঘারে কামড় বসাবে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে আসাদ ভাই ভয়ার্ত এক চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন।

আসাদ ভাইয়ের জ্ঞান যখন ফিরলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। মুখে জলের ছিটে পড়তে তিনি চোখ মেলে তাকালেন। ঝাপসা ভাবে দেখলেন অনেকগুলো উৎসুক মুখ তার দিকে ঝুঁকে আছে। কে একজন বললো,
-জ্ঞান ফিরছে, জ্ঞান ফিরছে।
মুখে লেগে থাকা জলটুকু মুছতে মুছতে আসাদ ভাই উঠে বসলেন। ভালোকরে চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তিনি একটা মাঠের মধ্যে রয়েছেন। পেছনে একটি মাত্র নারিকেল গাছ। আশ্বিন মাসের প্রখর সূর্যের আলোটাকে গাছটি সামান্যই আটকাতে পেরেছে। সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে সর্বত্রই কেবল ধান ক্ষেত। আসাদ ভাই কিছুই বুঝতে পারছেন না। এ তিনি কোথায় ? তিনি তো দিঝির পারে বসে ছিলেন। দিঘিটা কোথায় গেলো ? দশ বারো জনের ছোট্ট ভীড়টা ঠেলে সাদা দাড়িওয়ালা একজন পৌঢ় আসাদ ভাইয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আসাদ ভাইকে একবার দেখে নিয়ে পৌঢ় বললেন,
-বড় বাচা বাইচ্যা গেছো বাবা। ঐ বোয়াল মাছে যাদের একবার ধরছে তারা কেউ আর বাইচা বাড়ি ফিরতে পারে নাই। তোমার ভাগ্য ভালো, বাইচা গেছো।
আসাদ ভাই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন,
-এটা কোন্ জায়গা? বৃদ্ধ বললেন,
-এইডা মরাচাইলের মাঠ।
আসাদ ভাইয়ের বুঝতে আর বাকী রইলো না যে তিনি কোথায় কতোদূর এসে পড়েছেন।
হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, গত রাতে বেঁধে রাখা গামছাটা এখনও দুই হাতে প্যাঁচানো রয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো ক্ষত নেই। নারকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, গত রাতে মাছ সহ বেঁধে রাখা দড়িটা হালকা বাতাসে ঈষৎ দুলছে।