মোঃ মুজিবুর রহমান  

আজ ৯ নভেম্বর ২০১৫ , শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী। ১১ বছর আগে ২০০৪ সালের ৭ মে আহসান উল্লাহ মাস্টার ঘাতকচক্রের ব্রাশফায়ারে শহীদ হন। তাঁর জন্ম গাজীপুরের সাবেক পূবাইল ইউনিয়নের ( গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ) হায়দরাবাদ গ্রামে। ১৯৫০ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম। প্রকৃতির নিবিড় আবেষ্টনীতে ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা ছবির মতো দৃশ্যমান রেলপথ ঘেষা হায়দরাবাদ গ্রামের এক শান্ত কুটিরে ভূমিষ্ঠ হন আহসান উল্লাহ মাস্টার। বিনম্র চরিত্রের এই অসামান্য রাজনীতিক শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের পক্ষে  তাঁর অসাধারণ ভ ূমিকার জন্য শহীদ আহসান উল্লাহ সকলের অন্তর ছুঁয়ে আছে। 

বাঙালির সম্মান, গৌরব, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে যে সকল রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যে একজন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁর সংগ্রাম ছিল শ্রমিক-কৃষক- মেহনতি জনতার জন্য। তাদের জন্যই তিনি রাজনীতি করেছেন। খেটে খাওয়া মানুষসহ সকলকে আপন করে নেয়ার এক দুর্লভ গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি যেমন সাধারণ মানুষকে সহজে আপন করে নিতে পারতেন, তেমনি সাধারণ মানুষও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। সাধারণ মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় তিনি আপন আসন করে নিতে পেরেছিলেন। সেজন্য তাঁর প্রতি মানুষের তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল অপরিমেয়। তাঁর এই ভালবাসা , সারাটা জীবন সৎ থাকা এবং অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার পেছনে তা রাজনৈতিক দর্শন পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শও কাজ করেছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, যাট দশকে কিশোর-উত্তীর্ণ আহসান উল্লাহ মাস্টার বাঙালি জাতি সত্তায় বিশ্বাসী হয়ে সেই বয়ছেই বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শের অনুসারী হন। বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অবিচল। তিনি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি । রাজাকার - স্বৈরাচারের সাথে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারার রাজনীতি তিনি করেননি।
ষাট দশকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সম্পর্কে আহসান উল্লাহ মাস্টারের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ ছিলÑ “বঙ্গবন্ধু ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।” রেসকোর্স ময়দানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেনÑ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো হাজারো কর্মী তাঁদের নেতা বঙ্গবন্ধুর উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে এগিয়ে গেলেন অবিসংবাদিত নেতার দেখানো পথে, ঐক্যবদ্ধ হলো বাঙালি জাতি। আহসান উল্লাহ মাস্টার জীবন বাজি রেখে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে তরুণ আহসান উল্লাহ মাস্টার কেবল যে শ্রম বিষয়ক ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তা নয়, তাঁকে আমজনতার দরদী নেতার ভূমিকা পালন করতেও দেখা গেছে। সেই জন্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ব্যক্তি-সত্তার মধ্যে একজন সমাজদরদী মহান মানুষের চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রমিকদের অভাব অভিযোগ নিয়ে এবং তাদের স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টায় কোনদিনই তাঁকে পিছ পা হতে দেখা যায় নি। ধীরে ধীরে মেহনতি মানুষ তাদের এই দরদী নেতার এমন অন্ধ-অনুসারী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, তাঁর আহ্বানে দু’তিন ঘন্টার মধ্যে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হওয়ার বিচিত্র দৃশ্য অবাক-বিস্ময়ে ঢাকা-টঙ্গী-গাজীপুরের সবাই বার বার প্রত্যক্ষ করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে সম্মোহনীর শক্তির। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার তাঁর অন্তরের দরদ দিয়ে আমজনতার ভাল-মন্দ খোঁজ খবর নিতেন ও তাঁদের নিয়ে ভাবতেন বলেই তাঁর কথায় মানুষ সাড়া না দিয়ে পারতেন না। আর এভাবেই তিনি শ্রমিক ও জনতার দরদী নেতা রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। সমাজের সকল স্তরের মানুষের সঙ্গেই সমভাবে তিনি মিশতে পারতেন। গরীব-দুঃখীদেরই একজন হয়ে সাধারণ মানুষের সমাজেও তিনি অকৃত্রিমভাবে মেলামেশা করতে পারতেন। তাঁকে সবাই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। বিপন্ন অভাবগ্রস্থ মানুষের জন্য তাঁর অন্তরে সঞ্চিত ছিল সীমাহীন সহানুভূতি ও দরদ; এই জন্যই দেখা গেছে যে, গরীব-দুঃখীদের সহযোগিতার বেলায় তিনি অকৃত্রিম বন্ধু। শ্রম বিষয়ক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলে, সেই মামলার আইনী লড়াইয়ের জন্য আইনজীবী নিয়োগ ও মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল গঠনসহ বহুবিধ কর্মযজ্ঞের সাথে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার পরিচিত হয়েছেন। ঢাকা-টঙ্গী-গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানের নির্যাতিত ও ভোগান্তির শিকার শ্রমিকদের জন্য মামলা বিষয়ক আইনী লড়াইয়ের জন্য ছুটে যেতেন তিনি নিজে। অসাধারণ বন্ধুপ্রীতি ও অনুগত জনের প্রতি গভীর সৌহার্দ ও অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের অন্যতম গুণ। যাকে একবার তিনি বন্ধু বলে গ্রহণ করেছেন, তার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তিনি সর্বক্ষণ প্রস্তুত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার জীবন জোয়ার সৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে তাকে সুসংহত করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন- একজন মাঠের দক্ষ কর্মী । তিনি ছিলেন একজন দেশভক্ত প্রেমিক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।


শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। সমাজকে বড় করে দেখতে হলে মানুষকে বড় করে দেখতে হবেÑ এই ধ্যান-ধারণার বিশ্বাসী একজন ছিলেন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। আর সেই সমাজ বড় সম্মান করে আহসান উল্লাহকে তাঁর নামের সাথে একটি বিশেষণ জুড়ে দিয়েছিল ‘মাস্টার’ । এমনকি সেই থেকে তা তাঁর নামের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ ’আহসান উল্লাহ মাস্টার।’ তাঁর শিক্ষকতার আদর্শই তাঁর সমগ্র জীবনাচরণের অঙ্কুর ও শেকড়কে ধারণ করেছিল। এদিকে তাঁর সকল মানবিক গুণাবলি, কর্তব্য-পরায়ণতা, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, সাহসিকতা ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর সমুদয় সত্যনিষ্ঠায় যর্থাথই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিচয় এবং সম্মানসূচক বিশেষণ।
আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলেবেলা অন্য দশজনের ছেলেবেলার মতোই শুরু হয়। শিশু ও শৈশবে নিবিড় পল্লী- প্রকৃতিতে দিন অতিবাহিত করেছেন তিনি। ছয় ভাইবোন, অনেক বন্ধুবান্ধবের কলকাকলি এবং হাতছানির মধ্য দিয়ে দিনগুলো কেটেছে তাঁর। আহসান উল্লাহ মাস্টারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের হায়দরাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি টঙ্গী হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন থেকেই টঙ্গীতে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে নামে ছাত্র-ছাত্রীরা। সে সময়ে টঙ্গীতে যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনে স্কুল পড়–য়া ছাত্র আহসান উল্লাহ রাজপথে নেমে পড়েন। অংশগ্রহণ করেন মিছিলে। তখন থেকে ছাত্র লীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। টঙ্গী হাইস্কুল থেকে আহসান উল্লাহ ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকার পুরনো শহরের অবস্থিত বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজে (তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে ) একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন রাজপথে, তখনও ভাওয়ালের এই সন্তান আহসান উল্লাহ রাজপথের একজন সাহসী সৈনিক। এই রাজনীতির লড়াকু সৈনিক হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। তিনি পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন। বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা মিলে আন্দোলন গতি লাভ করে। সে সময়কার উত্তাপ্ত টঙ্গীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে যে সব সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো আয়োজনে যাঁদের নাম সর্বাগ্রে আসে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তরুণ ছাত্র নেতা আহসান উল্লাহ। সে সময়কার দিনে টঙ্গী, গাছা ও পুবাইল এলাকায় গণআন্দোলনে তিনি অভূতপূর্ব অবদান রাখেন । ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করে। আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার নিমিত্তে টঙ্গী-জয়দেবপুরের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন লড়াকু ছাত্রনেতা আহসান উল্লাহ । তিনি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে ‘মুজিব তহবিল’ এর জন্য প্রতিটি কুপন ১০ পয়সা করে বিক্রয় করে অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সকল কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৮ সালের গণজোয়ারের সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। ছাত্রনেতা আহসান উল্লাহ ১৯৬৯ সালের ছাত্রের ১১ দফার ভিত্তিতে গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রবল গণজোয়ার ও গণঅভ্যুত্থানে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকায় প্রদত্ত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে টঙ্গী থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সাথে আহসান উল্লাহ যোগদান করেন। দশ লক্ষ লোকের সেই জনসভায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে যতবার প্রার্থী হয়েছেন আমাদের জনগণের নেতা শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার একটিবারের জন্য হারেননি। জিতেছেন বিপুল ভোটে। জয় করে নিয়েছেন গণ-মানুষের হৃদয় ও অকৃত্রিম ভালবাসা। তিনি ১৯৯০ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের পূবাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হবার পর থেকে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার উপজেলা পদ্ধতি বিলোপ করে দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিয়ে আহসান উল্লাহ মাস্টার দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এজন্য তিনি জেল, জুলুম এবং নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। উপজেলা বিলোপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন। তারই বিজয় আজ দেশে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তব ফল হিসেবে বিরাজ করছে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়ন, পেশাগত ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানী বন্ধ করার দাবী নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন প্রতিনিয়ত। দেশে যখন ত্রাস ও গ্রাসের রাজনীতির বলয় তৈরি হয়েছে তখনই শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে দেখা গিয়েছে টঙ্গীর রাজপথে এবং ঢাকার রাজপথে। তিনি ১৯৮৩ সাল, ১৯৮৪ সাল, ১৯৮৭ সাল, ১৯৮৮ সাল ও ১৯৯০ সাল, ১৯৯৫ সাল, ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক পটভূমিতে শ্রমজীবী নেতা হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা গর্ব করার মতো। উল্লাহ
২০০১ সালে শ্রমিক-কর্মচারীদের নিকট রাষ্ট্রায়ত্ত ০৯টি বস্ত্র শিল্পের মালিকানা হস্তান্তরের মাধ্যমে মিলগুলো বেসরকারীকরণে যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনে যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম বাস্তবে কাজে লেগেছে, তিনি হচ্ছেন শ্রমিকদের পরীক্ষিত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার। শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারের প্রশ্নে কোনদিন আপোষ করেননি। শ্রমিক অসন্তোষ যেখানে দেখা দিয়েছে, সেখানেই নিজে ছুটে গিয়েছেন। শ্রমিক অসন্তোষের সময় খেয়াল রেখেছেন শ্রমিক কেউ অসন্তোষকে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নিজের ফয়দা হাসিল না করতে পারে। দর কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করার নিরন্তর চেষ্টাকে তাঁকে সফল নেতায় পরিণত করেছে। প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে বন্ধ ও রুগ্ন কলকারাখানা চালুর উদ্যোগ নেওয়া, পাটসহ জাতীয শিল্প রক্ষা ও কৃষকদের স্বার্থে কাঁচা পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ শ্রমিক-কৃষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন ভাওয়ালের এই কৃতী সন্তান শহীদ আহসান উল্লাহমাস্টার। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের আইনি অধিকার নিশ্চিত করা, নারী শ্রমিক স্বার্থ সম্বলিত দাবী বাস্তবায়ন ও বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে মজুরি ও বেতন-ভাতা নির্ধারণ করার জন্য দেশের নীতিনির্ধারণী মহলের সচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গত শতকের আশির দশকে গঠিত শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের(স্কপ) লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য শহীদ আহসান উল্লাহমাস্টার নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তিনি আই এল ও কনভেনশন ‘৮৭ ও ‘৯৮ এর ভিত্তিতে শ্রম আইন সংশোধনের দাবি করেছেন।
শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার যেমন ছিলেন শিক্ষক আবার ছিলেন শিক্ষকদের নেতা। শিক্ষকদের পেশাগত দাবির সমর্থনে রাজপথে ছিলেন তিনি। টঙ্গী-গাজীপুরে বেসরকারী অনেক শিক্ষকের মান্থলি পে অর্ডার ( এমপিও ) ভুক্ত করার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারী অনুদান প্রাপ্তিতে সহায়তা করেন।
শহীদ আহসান উল্লাহমাস্টার ছিলেন দশের মধ্যে একক। তাঁকে মানুষ ভক্তি করতো, তিনিও মানুষকে ভক্তি করতেন। স্বাতন্ত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে আর দশজন থেকে তাঁকে পৃথক করা যায় এবং তিনি দীপ্যমান হয়ে উঠেন জ্যোতির্ময় সূর্যের মতো। সকলের প্রিয় শহীদ আহসান উল্লাহমাস্টার ছিলেন সর্বস্তরের মানুষের গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বি জনগণমন অধিনায়ক। দেশ ও মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার বহুমুখী প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। এ রকম ব্যক্তিকে বাংলার মাটিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২০০৪ সালের ৭ মে, শুক্রবার। দেশ হারায় নন্দিত মানুষকে, যিনি ছিলেন সহস্র তরুণের আদর্শ, যিনি ছিলেন জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারার একজন রাজনীতিবিদ ও একজন মানুষ গড়ার কারিগর। বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টার একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় মরেননি; যুদ্ধ করেন যে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে , সেই পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। তাঁকে হত্যা করে স্বাধীন দেশের মাটিতে ঘাতকচক্র।

মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একজন মানুষ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। তাঁর সঞ্চয় ছিল শুধু মানুষের ভালবাসা। আবার ছিল না বৈভব-বিত্ত । আজন্ম শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তাঁর নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার প্রমাণ করেছেন মানুষকে ভালবাসলে, তাদের জন্য কাজ করলে ও জীবন উৎসর্গ করলে মানুষ ভালবাসায় তার প্রতিদান দেয়।
গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। গণতন্ত্র , অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নমুূখিতায় অবিচল ছিলেন তিনি। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের সংগ্রামী মনন ও আন্তরিক কর্মনিষ্ঠা ইতিহাসের উজ্জ্বলতায় বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জীবন সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে ও আদর্শে সমুজ্জ্বল হয়ে । আর সে কারণেই দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করি তিনি ছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী ও নন্দিত সংগ্রামী মানুষ।
আজকের জন্মবার্ষিকীতে সেই নন্দিত সংগ্রামী মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।