নিউজ ডেস্ক: হলুদ শাড়ি পরা মিষ্টি মেয়েটি একগুচ্ছ ফুল হাতে দিয়ে বলল, আমি এশা। ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে।
অক্সফোর্ড বুকসের দরজায় ঢাকঢোল বাজছে। ভেতরে উৎসব আয়োজন। অলস পথচারীর কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, বইয়ের দোকানে কী হচ্ছে!

এই অবস্থা আমারও। বুকশপের ভেতর সাহিত্য উৎসব! এমন ঘটনা দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি কোনো দিন। এত বড় বড় লেখক-কবি আসবেন, নাটক, সিনেমা ও গানের ব্যক্তিত্বরা আসবেন, দর্শক-শ্রোতা থাকবেন প্রচুর, তাঁরা বসবেন কোথায়, দাঁড়াবেন কোথায়! চারদিকে তো শুধু বই আর বই।

তাকিয়ে তাকিয়ে অক্সফোর্ডের ভেতরটা দেখছি। ৯৬ বছরের পুরনো দোকানটি পার্কস্ট্রিট আলোকিত করে দাঁড়িয়ে আছে। একতলা ও দোতলা মিলে পাঁচ-ছয় হাজার স্কয়ারফুটের মতো জায়গা। পুরনো আমলের ঘোরানো সিঁড়ি, কোথাও কোথাও কাঠের মেঝে। মূলত ইংরেজি বইয়ের দোকান। কয়েক বছর ধরে বাংলা বইও রাখছে। ভেতরে ঢুকলে বইয়ের গন্ধে স্নায়ু উত্তেজিত হয়।

১০ অক্টোবর সকাল ১১টা। অক্সফোর্ডের ভেতর যেটুকু ফাঁকা জায়গা, সেটুকু ভরে গেছে চেয়ারে। দোতলায় উঠেই সামান্য ফাঁকা জায়গা, সেখানেও চেয়ার। পেছন দিকটায় কাঠের মেঝে, সেখানে প্রচুর টেলিভিশন ক্যামেরা। বাংলাপিডিয়া কর্মীরা একপাশে ল্যাপটপ ইত্যাদি নিয়ে বসেছেন। আর সামনের দিকে আট-দশ ফুট চওড়া লম্বা মতো স্পেসে তিন-চারটা চেয়ার, একটা নিচু ধরনের টেবিল, টেবিলে তিনটা হ্যান্ড মাইক। একপাশে পোর্ডিয়াম, মাইক। শ্রোতা-দর্শকের দখলে চলে গেছে চেয়ার। যাঁরা চেয়ার পাননি, তাঁরা দাঁড়িয়ে। 'তিল ঠাঁই আর নাহি রে'।

ততক্ষণে ত্রিদিবদা, সুধাংশুদা চলে এসেছেন। শাশ্বত সেনগুপ্তর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে। তিনি অক্সফোর্ড বুকসের সিইও। হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ। চাপা উত্তেজনা, ফিসফাস শুরু হলো তখনই। প্রায় একসঙ্গে ঢুকলেন শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত আমি। রয় নামের অত্যন্ত সুদর্শন ও সুকণ্ঠ যুবক অনুষ্ঠান ঘোষণা করল। সাহিত্যের ওই তিন মহিরুহর সঙ্গে আমি আর ত্রিদিবদা। এ সময় আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলেন কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার জকি আহাদ। মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হলো।

উদ্বোধনের পর কিছু কথা বলার নিয়ম। শঙ্খ ঘোষ কথা বলবেন না, এই শর্তে অনুষ্ঠানে এসেছেন। তাঁর হাঁটাচলা ধীর, চিরকালের নম্র ও বিনয়ী মানুষ, কথা বলেন অত্যন্ত নিম্নস্বরে। শর্ত মনে না রেখে ত্রিদিবদা তাঁকে অনুরোধ করলেন কিছু বলার জন্য। শঙ্খদা মৃদু হেসে অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করলেন।

বাংলাদেশ থেকে আমরা দুজন লেখক আমন্ত্রিত ছিলাম। সেলিনা হোসেন এবং আমি। সেলিনা আপা বিশেষ কাজে আটকে গেলেন, আসতে পারেননি। আমি সেলিনা আপাকে খুব মিস করছিলাম।

অনুষ্ঠান দিনব্যাপী, সাত ভাগে ভাগ করা। উদ্বোধনের পর প্রথম পর্বের বিষয় 'এপার বাংলা ওপার বাংলা, সাহিত্যের ভাষা কি বদলে যাচ্ছে?' আলোচক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার এবং আমি। সঞ্চালক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। ত্রিদিবদার প্রতিষ্ঠান 'পত্রভারতী' এই সম্মেলনের সহনিবেদক।

দর্শক সারিতে আমার পরিচিত লেখকদের মধ্যে প্রচেত গুপ্তকে দেখতে পেলাম। নিচতলায় বসার জায়গা পায়নি আমার বন্ধু জলি নন্দীঘোষ। ওখান থেকে হাত নাড়ল। আমার তখন হাত-পা কাঁপছে। একপাশে বসে আছেন সমরেশ মজুমদার, আরেক পাশে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মাঝখানে আমি সঙ্কুচিত হয়ে আছি। ত্রিদিবদা তাঁর চমৎকার কণ্ঠে, স্মার্ট ভঙ্গিতে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। প্রথম আলোচক সমরেশ মজুমদার। সমরেশদা বাংলাদেশের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ। বছরে দু-তিনবার বাংলাদেশে যাচ্ছেন। লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, প্রকাশক ও ভক্ত মিলিয়ে বাংলাদেশে তাঁর বন্ধুবান্ধব অনেক। বাংলাদেশের লেখকদের শব্দ ব্যবহার নিয়ে তিনি কথা বললেন। যেমন-জামাই, জিম্মি, মজা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশি বইয়ের একটা মেলা হয়েছিল কলকাতায়। সেখানকার এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, গোসল, পানি-এ রকম বহু শব্দ বাংলাদেশের লেখকরা ব্যবহার করেন বলে পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে বাংলাদেশি লেখকরা গ্রহণযোগ্য হচ্ছেন না। খবরের কাগজ পড়ে এই তথ্য আমি জেনেছি। এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসবে কথা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের লেখার উল্লেখ করলেন তিনি, আমার লেখার উল্লেখ করলেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় বাংলাদেশের প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ তিনি পান। আর আমার লেখায় পান সমরেশ বসু ও মতি নন্দীর লেখার স্বাদ। তাঁর কথায়, আমি নাকি অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গের ভাষায় লিখি।

সমরেশদার পর আমার পালা। বললাম, সাহিত্যের ভাষা বদলায় লেখার বিষয় এবং সময়ের কারণে। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু বইয়ের উদাহরণ দিলাম। যেমন-সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'। 'নূরজাহান' উপন্যাসের কথা বললাম। সাড়ে বারো শ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির পরতে পরতে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পশ্চিমবঙ্গে খুবই গ্রহণযোগ্য লেখক। তাঁর 'খোয়াবনামা' উপন্যাসটির পাঁচ-সাতটা সংস্করণ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন শব্দ ঢোকে ভাষায়। সেসব শব্দ সাহিত্যে লুফে নেন লেখকরা।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, প্রতিদিন কত নতুন নতুন শব্দ ঢুকে যাচ্ছে ভাষায়। আমি তো মাছ শিকারির মতো ছিপ ফেলে বসে থাকি শব্দ ধরার জন্য। বাংলা ভাষা আজ যেমন আছে, তেমন নাও থাকতে পারে। সাংকেতিক হয়ে উঠতে পারে।

বেশ জমল শুরুর পর্বটি। উঠে দর্শক সারিতে যাচ্ছি, কাবেরী রায়চৌধুরী এসে জড়িয়ে ধরল। সে বাংলাদেশের বউ। আমার পাঞ্জাবির বাঁ হাতে কাবেরীর লিপস্টিক লেগে গেল। এই নিয়ে হাসাহাসি। প্রচেত পরিচয় করিয়ে দিল উল্লাস মল্লিকের সঙ্গে। শঙ্খদা আমাদের আলোচনা শুনেছেন। চলে যাওয়ার সময় বললেন, খুব ভালো হয়েছে।

অক্সফোর্ডের ছেলেমেয়েরা সেদিন হলুদ শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। হাসিমুখে চা-কফি দিচ্ছে সবাইকে। একেবারেই অন্য রকম এক সাহিত্য উৎসব চলছে। ঢাকায় আমার ঘোরতর ব্যস্ত সময় কাটে। 'কালের কণ্ঠ' সম্পাদক হওয়ার পর থেকে কত প্রিয় জায়গায় যাওয়ার সময় হয় না। এই উৎসবে এসে মনে হচ্ছে, বহু দিন পর প্রাণ খুলে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারছি।

দ্বিতীয় পর্বের বিষয় 'পাঠকের জন্য লিখি, না মনের তাগিদে?' সঞ্চালক দীপান্বিতা রায়। আলোচক বাণী বসু, প্রচেত গুপ্ত, অনীশ দেব, উল্লাস মল্লিক। ওঁরা প্রত্যেকেই খুব সুন্দর বললেন। বিশেষ করে প্রচেত। আর উল্লাস তো ওঁর লেখার মতোই রসে টইটম্বুর। অনীশ একটু গম্ভীর। বাণীদি দীর্ঘদিন শিক্ষকতায়। লেখায় নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেন। তাঁর বক্তব্য একটু যেন রাশভারী।

পরের পর্ব মধ্যাহ্ন বিরতির পর। ভাত, মাছ, ডাল এবং রসগোল্লা। চমৎকার খাওয়া হলো। তার পরের পর্ব 'বিতর্ক না হলে সাহিত্য জনপ্রিয় হয় না।' এই পর্বে উপস্থিত একজন বিতর্কিত লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা রকমের উপন্যাস লিখে বিতর্কিত এবং জনপ্রিয়। এই পর্বের অন্য আলোচকরা হচ্ছেন-স্বপ্নময় চক্রবর্তী, তিলোত্তমা মজুমদার এবং কাবেরী রায়চৌধুরী। তিলোত্তমা হলুদ শাড়ি পরেছেন। আগের তুলনায় স্লিম। সব মিলিয়ে নামের মতোই লাগছিল তাঁকে। (তিলোত্তমা, তোমার সেদিনকার সৌন্দর্য এখনো আমার চোখজুড়ে)। এই পর্বে সবচেয়ে ভালো বললেন তিলোত্তমা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য কীর্তি 'রাধাকৃষ্ণ' উপন্যাসটির কথা বললেন ভারি সুন্দর করে। স্বপ্নময়ের বক্তব্যে রসবোধ ছিল। দর্শক-শ্রোতারা মজা পাচ্ছিলেন তাঁর কথা শুনে।

বিনোদ ঘোষালের লেখা আমি পছন্দ করি। সমরেশ বসুর পুত্র লেখক নবকুমার বসুর লেখা পেলেই পড়ি। পরের পর্বে ওঁদের কথা শুনে ভালো লাগল। কলকাতার এখনকার লেখকরা খুব স্মার্ট। লেখা এবং জীবনাচরণ দুটোকে এখনকার লেখকরা একসূত্রে গাঁথতে পেরেছেন। ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছেন হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত। এত সুন্দর বক্তব্য রাখলেন তিনি, আমার খুব ভালো লাগল।

পরের পর্বটি ছিল 'সিনেমার সাহিত্য, না সাহিত্যের সিনেমা'। একটু গুরুগম্ভীর আলোচনা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কমছে দর্শক-শ্রোতা। আমি বসে আছি কবিতা শোনার আশায়। পরের পর্বে কবিতা পাঠ। বীথি চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানটি বেশ জমল। পিনাকী ঠাকুর আর শ্রীজাত'র অন্য আরেক জায়গায় যেতে হবে কবিতা পড়তে। ওঁরা দ্রুত কবিতা পড়ে চলে গেলেন। শ্যামলকান্তি দাশ কবিতা পড়ছেন, মাইক ডিস্টার্ব দিচ্ছিল। কবিতাপ্রেমী এক মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, আমি অনেক দূর থেকে কবিতা শোনার জন্য এসেছি। মাইকের জন্য পরিষ্কার শুনতে পাইনি। আবার পড়ুন। শ্যামল মৃদু হেসে আবার ওই লম্বা কবিতাটি পড়লেন। ব্যাপারটা আমার এত ভালো লাগল! কবিতার জন্য এত ভালোবাসা। কবিতাপ্রেমী সেই ভদ্রমহিলা, আপনাকে অভিবাদন।

বিনায়কের কবিতা খুবই পছন্দ করি আমি। মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুনলাম ওঁর কবিতা। এক ফাঁকে বিনায়কের উপন্যাস 'সোহাগিনীর সঙ্গে এক বছর' প্রসঙ্গ তুললাম। এই উপন্যাসের পেছনের গল্পে বিনায়ককে ঢুকিয়ে দিলেন ত্রিদিবদা। কবি ও ঔপন্যাসিকের প্রেমপর্ব নিয়ে বেশ মজা হলো।

সকাল থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার বন্ধু সুবোধ সরকারের জন্য। সুবোধ আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি। ওঁর কবিতা কখনো কবিতা, কখনো সমসাময়িক সময়ের প্রতিবেদন, কখনো উপন্যাস, কখনো বা ছোটগল্প। মনে আছে, সুবোধের 'ইস্তানবুল ভ্রমণ' পড়েছিলাম 'দেশ' পত্রিকায়। পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম, ইস্তানবুল চলে গিয়েছিলাম বেড়াতে। এবারের 'দেশ' শারদীয়ায় বেরিয়েছে সুবোধের এক আশ্চর্য কবিতা 'হনুমান চালিসা'। ছাপা হওয়ার পরপরই বিতর্ক শুরু হয়েছে কবিতাটি নিয়ে। আমার অনুরোধে সেই কবিতা পড়ল সুবোধ। এত সুন্দর ভঙ্গি পড়ার! পাঠক সারিতে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলাম।