তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর অতিবাহিত হলেও তাড়াশ উপজেলার ২ জন বীরাঙ্গনার আজও বীরঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বা তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বীরঙ্গনার তালিকাভুক্তির জন্য সরকারের নিকট আবেদন করেছেন তারা। বীরঙ্গনা ১জন তাড়াশ উপজেলার মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়াবিনোদ গ্রামের এবং অপর জন তাড়াশ সদর গ্রামের উত্তর পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা।

খোজ নিয়ে জানাযায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনীর লোকজন উপজেলার মাগুড়াবিনোদ গ্রামের মৃত ছমির প্রামানিকের স্ত্রী পাতাসী বেওয়া (৬৫) ও তাড়াশ গ্রামের মৃত ফাজিল আকন্দর স্ত্রী পচী বেওয়াকে (৬৬) পাক বাহিনীর লোকজন শারিরিক ও মানুষিকভাবে নির্যাতন চালায়। যুদ্ধের দাবানলের সময় গ্রামে পুরুষ শূন্য হয়ে হলে পাকবাহিনীর লোকজন দেশীয় রাজাকার আলবদর এর সহযোগিতায় রাতের পর রাত তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। জীবনের ভয়ে পাক বাহিনীর সকল অত্যাচার নির্যাতন নিরবে সহ্য করে থাকতে হয়েছে তাদের। মান সন্মানের ভয়ে কারো কাছে মুখ খুলতে সাহস পায়নি তারা।

ইতিমধ্যে পচী বেওয়া মারা গেছে, রেখে গেছে তারে ৩ ছেলে ২ মেয়ে। আর পাতাসী বেওয়া ৪ ছেলে ৩ মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নারী হিসেবে জীবনের সব হারিয়ে অবশেষে বেচে থাকার তাগিদে জীব যুদ্ধের পরাজিত সৈনিক পাতাসী বেগম মুখ খুলেছেন। সরকারীভাবে তালিকাভুক্তির জন্য উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের মাধ্যমে সরকারের নিকট আবেদন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভিষিকাময় দিন গুলির বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে কান্না জনিত কন্ঠে পাতাসী বেওয়া জানান, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি সেইদিন পাক হানাদার বাহিনীর লোকজনের কাছে। একজন নারীর যা থাকার প্রয়োজন তা আজ আমার নেই। চোখ লজ্জার ভয়ে দিনে পর দিন, মাসের পর মাস ঘরের মধ্যে বসে থেকেছি আর চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছি। মনের কথা কাউকে বলতে পানি নাই। এমনকি সংসার ভেঙ্গে যাবে ভেবে প্রাণ প্রিয় স্বামীকে সেদিনের কথাগুলো বলতে সাহস পায়নি। জীবন যুদ্ধে সব হারিয়ে আজ বেঁচে থাকার তাগিদে সেই দিনের কথা বলতে হচ্ছে। যুদ্ধের অনেক বছর পার হলে গেছে, কেউ আমার খোঁজ খবর নেয়নি। আর আমি নিজেই সেদিনের কথা কি ভাবে মানুষের নিকট বলব তা ভেবে পায়নি। সেই সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বা বীরঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সমাজের লোক জনের নিকট মুখ দেখানোর লজ্জায় এতদিন নিরব নিশ্চুপ ছিলাম। সংসার চালাতে গিয়ে মাঝে মধ্যে মনের কাছে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছে। একবার আত্মহত্যা করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাও করতে পারি নাই। ছেলেরা বিয়ে করার পর আলাদা সংসার করছে। তাদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমাকে ভাত কাপড় দেওয়ার মত সাধ্য তাদের নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে। পাকবাহিনীর শত নির্যাতন সহ্য করেও বেঁচে আছি এই ভরসায় যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যারা আমাদের অত্যচার নির্যাতন করছে তাদের বিচার যেন আল্লাহ করেন। বর্তমান আমার দাবী আমাকে বীরঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকা ভুক্তির মাধ্যমে সরকারী ভাবে সহযোগিতা পেলে সব ভুলে যাব। ভুলে যাব সেই দিনের সব কথা।

তাড়াশে ২জন বীরঙ্গনার আবেদন সম্পর্কে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গাজী আরশেদুল ইসলাম আরশেদ জানান, তারা এত দিন নিশ্চুপ থাকায় তাদের সম্পর্কে আমরা এত কিছু জানতে পারি নাই। বিষয়টি জানার পর তাদের আবেদন গ্রহন করা হয়েছে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরের নিকট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রেরণ করা হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা বা বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দেবার জন্য। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় বিষয়টি জটিল আকার ধারন করেছে। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা। তাড়াশে পাকবাহিনী দীর্ঘদিন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। অবশেষে তাড়াশে নওগা পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হতে হয়েছে। পাকবাহিনীর ও দেশীয় রাজাকার আলবদর বাহিনীর তাড়াশে বহু নারীর উজ্জত হরণ করেছে। কালের গর্ভে সব হারিয়ে গেছে। অনেকেই মারা গেছে আবার অনেকেই চোখ লজ্জার ভয়ে বলতে পারে নাই। সচেতন এলাকাবাসির মনে করেন তাড়াশের বীরঙ্গনাদের খুজে বের করে সঠিক তালিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভাবে তাদের সম্মান জানানো উচিত।

(এসএমএইচ/এইচআর/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৫)