শেরপুর প্রতিনিধি : মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীা যৌথ নেতৃত্বে পাকাহানারদের দখল হতে শেরপুর জেলা মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। গৌরব গাঁথা সে দিনটির কথা শেরপুরবাসীর স্মতিতে আজও ভাস্বর হয়ে আছে। সেইদিন একদিকে বিজয়ের অনাবিল আনন্দ, অপরদিকে স্বজনহারাদের আহাজারি-এর মাঝে শেরপুর টাউনে শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করেছিলেন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা। মুক্ত শেরপুরবাসী তাকে স্বাগত জানায়।

মিত্র বাহিনীয় উপস্থিতিতে সেদিন পৌর পার্ক মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে উপস্থিত জনতা চারদিক মুখরিত করে তোলে। এখানে দাঁড়িয়েই তিঁনি বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, মস্কো, আকাশবাণী সহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেস। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি শেরপুর জেলার আপামর জসসাধারণের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময়, গৌরবোজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয় দিন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত: নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শেরপুরে শত্রু সেনাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি এবং পাশ্ববর্তী বকশীগঞ্জ অঞ্চলে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা লড়াই। এ লড়াই চুড়ান্ত রূপ নেয়া শুরু হয় নভেম্বর মাসে। এ মাসের শেষ সপ্তাহে শেরপুর-জামালপুর সেক্টরে পাক বাহিনীর দূর্জেয় ঘাঁটি হিসাবে কথিত কামালপুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী উপর্যুপুরী সাঁড়াশি আক্রমন চালায়। ফলে ৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর এ দূর্জেয় ঘাঁটির পতন ঘটে। তারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে দ্রুত এ অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গুটাতে শুরু করে। ঝিনাইগাতীর আহমদনগর সেক্টর হেডকোয়ার্টারসহ ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী শেরপুর ত্যাগ করে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুরে আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনীকে জামালপুর থেকে হটাতে গিয়ে ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ৬ জওয়ান শেরপুরে শহীদ হন। অপরদিকে, ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ি ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্ত পথে ৭ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধার দল যথাক্রমে ক্যাপ্টেন আজিজ, জাফর ইকবাল ও রহুল আমিন তোতার নেতৃত্বে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে।

মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীন। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস জেলার বর্তমান ৫টি উপজেলার ৩০/৪০টি এলাকায় ছোট বড় যুদ্ধ হয়েছে। এ সমস্ত যুদ্ধে বীরত্বের সংগে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন ৮৪ জন বীর সন্তান। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন অসংখ্যা নিরীহ মানুষ। ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নারী-পুরুষ, শিশু সহ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সোহাগপুর গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় বিধবাপল্লী। শ্রীবরদীর জগৎপর গ্রামে পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় নারকীয় তান্ডব চালিয়ে হত্যা করে ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী ও গ্রামে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের। ২৪ নবেমবর সদর উপজেলার সূর্য্যদী গ্রামে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন ৬৯ জন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য এ জেলার একজন বীর বীরবিক্রম, দুইজন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন। এরা হলেন, ‘শহীদ শাহ মু’তাসীম বিল্লাহ খুররম বীর বিক্রম’, ‘কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি বীর প্রতীক বার’ ও ‘ডা. মাহমুদুর রহমান বীর প্রতীক’। এ তিন বীর সন্তানই শ্রীবরদী উপজেলার বাসিন্দা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা জানান, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান শেরপুর অঞ্চলে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তখন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও আলবদর কমান্ডার ছিলেন। কামারুজ্জামানের সহযোগী হিসেবে তৎকালীণ ছাত্রনেতা কামরান, নাসির, কামাল, গণহত্যয় অংশ নিয়েছেন। তৎকালীণ মুসলিম লীগ নেতা ডা. সামেদুল হক, তজম্মল চৌধুরী শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এ বছরের এপ্রিল মাসে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়।

মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ বলেন, দেরীতে হলেও দেশে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে, এ বিচার আমাদের বাঙালী জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবে। তরুণ প্রজন্ম আজ যুদ্ধাপরাধিদের ফাঁসির দাবীতে জেগে ওঠেছে। এটা আমাদের বেশ আশান্বিত করেছে যে, বাঙালী মাথা নোয়াবার নয়। ইতোমধ্যে আমাদের এলাকার আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের ফাসি হয়েছে। দেশের আরও কয়েক যুদ্ধাপরধির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, অনেকের ফাঁসির দন্ড হয়েছে। আমরা অন্যান্য যুদ্ধপরাধিদেরও ফাঁসি দেখে মরতে চাই।

(এইচবি/এইচআর/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫)