মোঃ আশিকুল ইসলাম চয়ন : নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদী, ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রি হিসেবে শপথ নিলেন গত ২৬/০৫/২০১৪ তারিখে।  কে এই মোদী? তার জবাব হয়ত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার দরুন সকলেই অবগত আছেন। তারপরও তার কিছু স্বরূপ উপস্থাপনা করা উচিত।

চা বিক্রেতা, সাধু, সন্ন্যাসী ,দাঙ্গাবাজ, মুখ্যমন্ত্রি থেকে প্রধানমন্ত্রি সবই ছিলেন মোদী একজীবনে।

মোদী বনাম সমগ্র ভারত নামের যুদ্ধে ভারত কে পরাজিত করে মোদীর সিংহাসন আরোহণ। সমগ্র ভারতের পরাজয় মানে অসাম্প্রদায়িক ভারতের পরাজয়। যে মানুষের হাত দুই হাজার মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়, সেই হাত কি করে ২০ কোটি মুসলমান সহ ১২৫ কোটি মানুষের ভারতের দায়িত্ব নিতে পারে ? গুজরাটে দাঙ্গার পাশাপাশি উন্নতি যে করে নাই মোদী, এমন মিথ্যা বলার সাধ্য আমার নেই। মোদী হয়ত ভারতে সু-শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, অর্থনৈতিক মজবুতি দান করবে কিন্তু কোন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন ভারতীয়র মন থেকে দাঙ্গার আশংকা দূর করতে পারবে কি? এশিয়াই বিরল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় মঞ্চে অভিষেক হোল মোদীর।

মোদী যে একজন ভালো রাষ্ট্র নায়ক হবে, তা তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারা যায়। প্রভাতই বলে দেয় দিবস কেমন হবে। শপথ অনুষ্ঠানে সার্ক ভুক্ত দেশ গুলোর সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো একটি ইতিবাচক দিক, আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া আরও বেশি ইতিবাচক দিক। বিশেষ করে পাকিস্থান কে আমন্ত্রণ জানানোটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ কেননা পাকিস্থানই একমাত্র দেশ যাদের সাথে ভারত সরাসরি একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এখনও কাশ্মীর সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। ঠিক এরকম স্নায়ু দ্বন্দ্ব পূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে মোদী যে খুব কৌশল গতভাবে অগ্রসর হবেন, তারই নমুনা মেলে পাক প্রধানমন্ত্রি কে আমন্ত্রণ ও তার সাথে প্রধানমন্ত্রি হিসেবে প্রথম কর্ম দিবসেই বৈঠক সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। ভারতের রাজনীতি ও গনতন্ত্র চর্চা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

প্রথমত: প্রায় ৮৬ কোটি ভোটারের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নির্বাচনে কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা বাদে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণা করা হয়। যা আমাদের দেশে দিন দিন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যার জলজ্যান্ত প্রমান মেলে উপজেলা নির্বাচনে।

দ্বিতীয়ত: ভারতে একটি নির্বাচিত সরকারে অধীনে নির্বাচন কমিশন কতটা যে স্বাধীন ভাবে কাজ করে, তার প্রমাণ মেলে প্রতিটি নির্বাচনে (পঞ্চায়েত, পৌরসভা, কর্পোরেশন, রাজ্য সভা, লোক সভা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন)। আর আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন কে ভারতের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আইনি কাঠামোয় আবদ্ধ রাখার পরও তারা সুষ্ঠু ,অবাদ ও জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন উপহার দিতে পারে না।

তৃতীয়তঃ ফলাফল মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি। ভারতের রাজনীতিবিদরা জানেন কিভাবে পরাজয় মেনে নিতে হয়। এবারের নির্বাচনে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে,তারপরও তারা পরাজয় মেনে নিয়ে নব নির্বাচিতদের অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং সেই সাথে শপথ অনুষ্ঠানে আধঘণ্টা পূর্বে গিয়ে অপেক্ষা করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রি মনমোহন সিং। এই ঘটনাগুলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেখার কোন সুযোগ নেই। প্রতিটি নির্বাচনের পরেই আমরা পরাজিত দলের কাছ থেকে শুনতে পাই নির্বাচনে পুকুর চুরি হয়েছে অথবা স্থুলূ কারচুপি হয়েছে,অভিনন্দন জানানোতো দূরের কথা।

মোদী তার মন্ত্রিসভা খুব সুচিন্তিত ভাবে গঠন করেছেন। যেখানে সুষমা স্বরাজ ও রাজনাথ সিং এর মত ঝানু রাজনিতিক স্থান পেয়েছেন আবার স্মৃতি ইরানির মত নবীন রাজনিতিকও ঠাই পেয়েছেন। কিন্তু মোদী যে পুরো আধিপত্য বিস্তার করবে মন্ত্রি পরিশোধের উপর তা বোঝাই যাচ্ছে,কেননা পাঁচ বছর পর মোদীকেই জনতার বিচারের মঞ্চে দাড়াতে হবে। মোদীর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তারমধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলঃ

১। অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুতি করণ।
২। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ।
৩। নতুন নতুন কর্ম ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করণ।
৪। বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি।
৫। প্রতিরক্ষা অবস্থা শক্তিশালী করণ।
৬। প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন।
৭। অভ্যন্তরীণ নানান ইস্যুতে কেন্দ্রের সাথে রাজ্য সরকারের সমন্বয় সাধন।
৮। দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গঠন।
৯। উগ্র হিন্দুবাদ দমন করে ভারতময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা।

ভারতের সাথে চারপাশের প্রতিবেশী দেশের নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অতপ্রত ভাবে জড়িত। প্রতিবেশীদের মধ্যে পাকিস্থান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও নেপাল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলংকার সাথে মোদী যেকোনো চুক্তি করতে হলে তামিল নাড়ু রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই করতে হবে। কেননা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তামিল নাড়ু রাজ্যের মুখ্য মন্ত্রি জয়ললিতা। ভারত-পাকিস্থান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কাশ্মীর ও জঙ্গি ইস্যু। আর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য মন্ত্রি মমতা ব্যানার্জি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নানান ইস্যু রয়েছে তার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলঃ

১। তিস্তা চুক্তি/ পানি বণ্টন চুক্তি।
২। ট্রানজিট ইস্যু।
৩। সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণ ও সীমান্ত হত্যা বন্ধ।

বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে ভারতের কংগ্রেস সরকারের ঐতিহাসিক সম্পর্ক একথা সবাই জানে, কিন্তু একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ভর করে অন্য দেশের পররাষ্ট্র নীতির উপর কোন দল বা পরিবারের উপর নয়, একথা যদি সত্য হয়, তাহলে হাসিনা সরকার কে মোদী সরকারের সাথে আমাদের স্বার্থ সম্পর্কিত ইস্যুতে গুরুত্বের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমাদের প্রাপ্য ও ন্যায্য অধিকার অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে। মোদী সরকার তাড়াহুড়া করে আমাদেরকে দিয়ে অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করে নিতে চাইবে, কিন্তু আমাদের কে আরও অধিক সংবেদনশীল হয়ে যুক্তি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। আর যারা ভাবছেন মোদী হয়ত এসে বাংলাদেশের সরকার পতন ঘটিয়ে দিবেন, তাদের আশায় নৈরাশ ছারা কিছুই পাবার নেই, এটা ভালো ভাবে মনে রাখতে হবে।

মোদীর সামনে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ, কারন মোদীই ভারতবাসীকে শিখিয়েছেন '' ভালো দিন আসছে '' তাই এই ভালো দিনের অপেক্ষাই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন ১২৫ কোটি ভারতবাসী । সেই সঙ্গে প্রতিবেশী প্রতিটি দেশ মোদীর কাছ থেকে অত্যন্ত সহযোগিতাপূর্ণ ও সুসম্পর্কময় বিদেশ নীতি আশা করছে। আর আমরা মোদীকে দেখতে চাই অসাম্প্রদায়িক ভারত নির্মাণের একজন পথিকৃৎ পুরুষ হিসেবে। যার হাতে সব ধর্মের, সব বর্ণের ও সব ভাষার মানুষ থাকবে নিরাপদ। ভারত এগিয়ে যাবে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই আমাদের প্রত্যাশা আর এটিই হোক মোদীর প্রত্যয় । মোদী ও সমগ্র ভারতবাসীর জন্য রইল শুভকামনা ...।

লেখকঃ নিবন্ধক ও আহব্বায়ক, দ্যা ফোরাম অব নিউ ভোটরস।