স্টাফ রিপোর্টার : শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্য গঠনের জন্য সুষম খাদ্য, মনের বিকাশের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও খেলাধুলা। অর্থাৎ খেলাধুলা শিশু স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য অপরিহার্য শর্ত।

তাদের মতে, সুস্থ্যভাবে বিকাশের জন্য একটি শিশুর দৈনিক কমপক্ষে এক থেকে দেড় ঘন্টা এবং সপ্তাহে ১০ থেকে ১৪ ঘন্টা খেলাধুলা করার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

অথচ দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে দেশের শহর ও নগরের পরিবেশ এমন যে, এখানে শিশুদের খেলাধুলার তেমন কোনো সুযোগই নেই। নেই প্রয়োজনীয় তেমন খেলার মাঠ। উপরোন্তু অপরিকল্পিত ও অতি দ্রুত গতিতে নগরায়নের ফলে শহরের সমস্ত ফাঁকা জায়গা একে একে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে একের পর এক গড়ে উঠছে আকাশ চুম্বি অট্টালিকা। ফলে শিশুদের জন্য উন্মুুক্ত স্থানের সংকট দিনে দিনে যেন বেড়েই চলেছে।

ফলে আজকাল শহরের শিশুরা আর আগের মত নিয়মিত খেলাধুলা করতে পারে না। তাদের শুধু নিজস্ব বিদ্যাপীঠের খেলার জায়গার ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ আজকাল শহরের অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল-কলেজের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ নেই। এমন কি কোন কোন স্কুলে পড়ালেখার বাইরে শিশুদের জন্য শারিরীক বা মানসিক বিকাশ ঘটানোর মত কোন তৎপরতার সুযোগই নেই। এসব স্কুলে শিশুরা শ্রেণীকক্ষে গন্ডিবদ্ধ হয়ে সময় কাটায়।

তাছাড়া শহরের বাসা-বাড়িতেও এমন কোন বাড়তি জায়গা থাকে না যেখানে শিশুরা খেলাধুলা বা ছুটোছুটি করে সময় কাটাতে পারে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শহরের শিশুদের এক ধরণের বন্দী জীবন কাটাতে হয়। যেটা তাদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এভাবে বেড়ে ওঠার ফলে অনেক শিশুই যে সুস্থ্য স্বাভাবিক চিন্তা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে। যা তাদের অপরাধ প্রবণ করে তোলে।

বিদ্যাপিঠে যেহেতু শিশুরা দিনের অনেক সময় ব্যয় করে তাই যেখানে তাদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকলে তারা অনায়াসে খেলাধুলা করে তাদের শরীর মনের বিকাশ ঘটাতে পারতো। অথচ শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে এমন সুযোগ খুব কমই ঘটে থাকে।

গ্রাম-গঞ্জের শিশুরা অবশ্য এই দিক দিয়ে বেশ ভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ, তারা প্রচুর খেলাধুলা করার সুযোগ পায়।

গ্রামে প্রচুর ফাঁকা জায়গা থাকায় শিশুদের জন্য খেলাধুলার স্থানের কোন অভাব হয় না। ফলে, গ্রামের শিশুরা ইচ্ছেমত খেলাধুলা আর ছুটাছুটি করে সময় কাটাতে পারে, যা তাদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের জন্য সহায়ক হয়ে থাকে।

খেলাধুলা এক ধরনের ব্যায়াম যা শিশুদের স্বাস্থ্য গঠনে সহায়তা করার পাশাপাশি মানসিক বিকাশের মাধ্যমে মনের উৎকর্ষতা দান করে। অথচ শিশুর স্বাস্থ্য গঠনে শহরের শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে এ খেলাধুলা থেকে।

ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে ৩৭ শতাংশ শিশু ঘরের মধ্যেই খেলাধুলা করে এবং ২৯ শতাংশ শিশু কোন খেলাধুলাই করে না। এই শিশুদের বিনোদনের একমাত্র সঙ্গী টেলিভিশন।

শিশুর মানসিক বিকাশের অনেকখানিই যেহেতু খেলাধুলার ওপর নির্ভরশীল তাই, তার সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে ঠিক সময়ে খেলাধুলা করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা উচিত।

শহরে সাধারণত দেখা যায়, ফুটবল, টেবিল টেনিস, বাসকেটবল ইত্যাদি প্রধান খেলা হিসেবে জায়গা পেয়েছে। অথচ গ্রামেগঞ্জে এখন উপরোক্ত খেলার পাশাপাশি হাডুডু, কাবাডি, সাতচারা, বউচি, দাড়িয়াবান্দা, কানামাছি, কুৎকুৎ, চোর-পুলিশ, লুকোচুরি, ইচিংবিচিং, ওপেনটিবায়োস্কোপ, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা ইত্যাদি এখনো বহুল প্রচলিত খেলা।

এসব খেলার ধরন ভিন্ন, আর ভিন্ন প্রকৃতির খেলার জন্য প্রস্তুতি ভিন্ন ধরনের হওয়ায় শিশুদের মনের মধ্যেও প্রকারভেদে আনন্দ দেয়। যা শিশুর মনে নানামুখী আনন্দের ধারা তৈরি করে চলে।

এছাড়া খেলাগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় শিশুদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের জন্য তা ব্যায়ামের কাজ করে। আপাতদৃষ্টিতে এর উপকার দেখা না গেলেও সবার অগোচরে এসব খেলাধুলা শিশুর স্বাস্থ্য গঠনে নীরবে কাজ করে চলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মনোবিকাশ ও স্বাস্থ্য গঠনে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই্। খেলাধুলা একদিকে শিশুর মনোবিকাশে সাহায্য করে অন্যদিকে সবাই মিলে একসঙ্গে খেলাধুলা করার ফলে তাদের মধ্যে এক ধরণের হৃদ্যতা ও আন্তরিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, যা তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনেও প্রভাব ফেলে।

শহরের শিশুরা ঘরে বসে ভিডিও গেম, টিভি দেখে সময় কাটাতে পছন্দ করে। এতে শিশুর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির বড় কারণ হলো তাদের চোখের ওপর দারুণভাবে চাপ পড়ে। তাদের চোখের এই ক্ষতির কারণে তারা পরবর্তী জীবনে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

একনাগারে বসে থাকার কারণে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হতে পারে। একনাগারে যাতে শিশুরা কম্পিউটারের সামনে বসে না থাকে সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। অনেক শিশু টিভি দেখে আর খাবার খায়, এভাবে খাবার খেলে বেশি খাবার গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া টিভিতে অপরাধমূলক সিরিয়াল দেখে দেখে শিশুর নেতিবাচক মানসিকতার সৃষ্টি করে। এসব কারণে অনেক শিশু অপরাধজগতের সাথে জড়িয়ে পড়ে। শিশু অপরাধীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। যা বর্তমান সমাজে আতংকের সৃষ্টি করে চলেছে।

শহরের শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে সরকারের কোন পরিকল্পনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, শিশুদের খেলাধুলার বিষয়টিকে সরকার খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কন্যা শিশুদের জন্য খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় যা বাস্তবায়ন করবে।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুর জন্য শরীর গঠন ও মনের প্রফুল্লতা বাড়ানো খুবই জরুরি একটি বিষয়। খেলাধুলা করলে শিশুর শারীরিক গঠন ও মনের প্রফুল্লতার ঠিকভাবে বিকাশ ঘটে। যে শিশু খেলাধুলার জন্য সুযোগ পায় না তার শারীরিক গঠন ও মনের প্রফুল্লতা বিকাশ বিঘ্নিত হয়’।

শিশুদের খেলাধুলার ব্যাপারে যে সমস্যা সরকারই পারে এর সমাধান দিতে। সরকার বিদ্যালয়গুলোতে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করে দিলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।

শহরের শিশুদের খেলাধুলার বিষয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এনজিও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবীরা এগিয়ে এলেও সহজে সফলতা আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

(ওএস/এস/মে ২৯, ২০১৪)