স্টাফ রিপোর্টার : নিজ দলের মধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে হেফাজত। মানবজমিন-এর করা একটি রিপোর্ট হতে জানা যায়, বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফী।

চাপা পড়ে গেছে তার ১৩ দফা কর্মসূচি। ভেস্তে গেছে সংগঠনটির মজলিশে শূরা গঠনের কার্যক্রম। ঘোষণা করতে পারেনি নতুন কোন কর্মসূচি। ঝিমিয়ে পড়েছেন লাখ লাখ নেতাকর্মী সমর্থক ভক্ত-অনুরাগী।

আর সংশ্লিষ্টরা জানান, এর পিছনের কারন হিসেবে উঠে এসেছে আমীরপুত্র আনাসের অর্থনৈতিক দুর্নাম, আমীরের বিতর্কিত বক্তব্য এবং সরকারের সঙ্গে তলে তলে সম্পর্ক।

২২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২০-২২ জন সদস্য

হেফাজতের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ২৩শে মে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা গঠনের লক্ষ্যে জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন হেফাজত আমীর। কিন্তু নগণ্য উপস্থিতির কারণে শূরা গঠন ভণ্ডুল হয়ে গেছে। আমীরপুত্রসহ শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মোটা অংকের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পাশাপাশি একের পর এক হেফাজত আমীরের বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে নেতাকর্মীরা আহমদ শফীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে অনেকের অভিমত। এ কারণে নিয়মিত হাটহাজারী মাদ্‌রাসার খতমে বুখারীর আয়োজনে শরিক হতে আসেন, এমন ওলামায়ে কেরামকে বৈঠকে শরিক করানোর কৌশল নিয়েও সফল হওয়া যায়নি। ফলে বৈঠকে ৩০-৩৫ জনের বেশি নেতা-কর্মীর জমায়েত করা সম্ভব হয়নি। এতে হতাশ আমীর শূরার মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকে সভাপতির আসন গ্রহণ না করে আধ ঘণ্টার মধ্যেই বৈঠক স্থল ত্যাগ করেন। তবে বৈঠকস্থল ত্যাগের আগে ‘সরকারকে গালিগালাজ সম্ভব নয়’ এটা বলে যেতে ভুল করেননি। ২২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটি ও ৩৫ সদস্যের কার্যকরী কমিটির নাম ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২০-২২ জন সদস্য। এ অবস্থায় হেফাজতের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর আর সম্ভব নয় বলেই অনেকে মনে করছেন।

সে দিনের বৈঠকে উপস্থিত ঢাকার এক হেফাজত নেতা জানান, হাটহাজারী মাদ্‌রাসার ২-৩ জন শিক্ষকসহ স্থানীয় ২০-২২ জন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ৬-৭ জন এবং ঢাকা মহানগরীর ১২-১৪ মিলে উপস্থিতি ৫০-এর কম ছিল। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ৯ই মার্চ হাটহাজারী ও ২১শে সেপ্টেম্বর ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদরাসায় ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনে সারা দেশ থেকে তিন হাজারের অধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অথচ কেন্দ্রীয় শূরা কমিটি গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে জাফরুল্লাহ খান, আব্দুর রব ইউসুফী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুফতি সাখাওয়াত ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকেই দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম থেকেও সিনিয়র নায়েবে আমীর, মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদক ছাড়া নেতাদের বৃহৎ অংশের অনুপস্থিতি ছিল খুবই হতাশাজনক। হাটহাজারীর আশপাশের এলাকাসহ চট্টগ্রামের অনেক নেতাকেও দেখা যায়নি বৈঠকে। দেখা যায়নি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির অনেক সক্রিয় নেতাকেও।

শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ আমীরের প্রশ্রয়ে আনাসের একচ্ছত্র আধিপত্যই দায়ী

নেতাকর্মীদের অনেকেই এজন্য শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যাপক আর্থিক অনিয়মসহ আমীরের প্রশ্রয়ে আনাসের একচ্ছত্র আধিপত্যকেই দায়ী করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, শূরা কমিটি গঠনের বৈঠক শুরু ২৩শে মে সন্ধ্যা ৭টায় হাটহাজারী মাদরাসার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এর আগে কয়েক দফা বৈঠকের মাধ্যমে শূরা গঠনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। আমন্ত্রণ জানানো ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিসহ দেশের সকল জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ শীর্ষস্থানীয় প্রায় ৫০০ আলেমকে। এ নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতিও ছিল হাটহাজারীর হেফাজত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। বৈঠক শুরুর এক ঘণ্টা পরও যখন উপস্থিতির সংখ্যা ৫০-ও হয় না, তখন মহাসচিবসহ আয়োজকদের চোখে মুখে বিমর্ষতা ফুটে ওঠে।

সূত্র জানায়, শাপলা ট্র্যাজেডির আহত-নিহতদের সহযোগিতার জন্য সংগৃহীত তহবিল তছরূপ সরকার ও বিরোধী দল থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে ধীরে ধীরে হেফাজত নেতারা দূরে সরতে থাকে। হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, নিজের দোষ ঢাকা দিয়ে নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই এ বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছেন আনাস। তার পক্ষে কাজ করছেন সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, অর্থ সম্পাদক কাতেব ইলিয়াছ ওসমানী, ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক নূর হোসাইন কাসেমী, জোনায়েদ আল হাবীব, জাফরুল্লাহ খানসহ আর্থিক সুবিধাভোগী কয়েকজন নেতা।

তার মতে, শূরা বৈঠকের এ আয়োজন ছিল অনেকটা আইওয়াশমাত্র। শূরা কমিটি গঠন ও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা তুলে দিয়ে একদিকে আমীর ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আলোচনা থেকে নেতাকর্মীদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া, অন্যদিকে শীর্ষ নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা কেলেঙ্কারিপূর্ণ সংবাদকে মিডিয়া ও নাস্তিক্যবাদের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ ছিল। পাশাপাশি দলীয় ফোরামে অন্ধ ভক্ত কয়েকজন নেতাকে দিয়ে আনাসকে আমীরপুত্রের দোহাই দিয়ে নির্দোষ ঘোষণার কৌশলও ছিল। কিন্তু নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির কারণে সব কৌশলই ভেস্তে গেছে।

আহমদ শফীর বক্তব্য ও কয়েক নেতা সভাস্থল ত্যাগ করল যে কারনে

আমীর নিজে বৈঠক ডেকে সভাপতির আসনে না বসে তড়িঘড়ি বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন। আটটার সময় হুইল চেয়ারে করে সভাস্থলে আসেন আহমদ শফী। তিনি সভাস্থলের এক পাশে হুইল চেয়ারে বসেছিলেন। এ সময় তার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আজিজুল হক ইসলামাদী। এরপর আমীর সংক্ষেপে নেতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমাদের হেফাজতের এ আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। জামায়াতের লোকজন চায় আমাদের দিয়ে ভাঙচুর করাতে, সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধাতে, রাস্তায় নামাতে। আমরা এটা করতে পারি না। খালেদা জিয়া চায় আমরা সরকারকে গালিগালাজ করি, হরতাল দিয়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনি। আমরা সরকারকে গালিগালাজ কেন করবো? আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কেন কথা বলবো? আমরা তো অরাজনৈতিক আন্দোলন করি। ১৩ দফার কথা সরকারকে আমরা জানাবো। সরকার মেনে নিলে ভাল। না মানলে আমাদের করার কিছুই নাই। জামায়াত-বিএনপি আমাদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করাতে চায়। সরকারকে গালাগাল সম্ভব নয়। আমরা ঈমান-আক্বিদার কথা বলে যাবো। এর বাইরে কিছু করার কথা আমরা বলি নাই।’

এ সময় আমীরের লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে মৌখিক বক্তব্যের বৈপরীত্য দেখে উপস্থিত সিনিয়র নায়েবে আমীর, মহাসচিবসহ সকলেই হতভম্ব হয়ে পড়েন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা বলেন, আহমদ শফীর এমন বক্তব্যের পর বেশ কয়েকজন নেতা চলে যান। রাত সাড়ে নয়টার পর বৈঠকের উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে।


নায়েবে আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী আল্লাহর কসম খেয়ে বলেছেন যেসব কথা

তিনি আরও জানান, বৈঠকের শেষ পর্যায়ে সিনিয়র নায়েবে আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন,আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সংগঠনের নেতৃত্বে যখন পদের আর অর্থের লোভ ঢুকে যায়, তখন সংগঠন ধ্বংস হয়ে যায়, সংগঠন ঠিক থাকে না। টাকার লোভ ও পদের লোভ পোষণ করে ঈমান-আক্বিদার আন্দোলন করা যায় না। সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে কোন ব্যক্তি টাকা খেয়ে থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে। ঈমান-আক্বিদার আন্দোলন করতে হলে পদের আর অর্থের লোভ আগে ছাড়তে হবে। আমি কসম করে বলছি, আমার পদ ও অর্থের কোনটার লোভ নাই। তিনি আরও বলেন, ‘যারা সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা-বিশ্বাস তুলে দিয়েছে, নাস্তিকতা চালু করেছে, আলেম-উলামাকে জঙ্গি বলছে, তারাও নাস্তিক। নাস্তিকদের যারা বন্ধু বলবে, আল্লাহর কসম, তাদের ঈমান থাকবে না। থাকতে পারে না। এ সময় উপস্থিত সকলে সমস্বরে তাঁকে সমর্থন করেন।

(ওএস/এটিআর/মে ৩১, ২০১৪)