মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ক্যাশ পেমেন্টের বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক ‘ফ্রড ম্যারেজ’ এর আশ্রয় নিয়ে যারা নরওয়েতে অনুপ্রবেশ করেছেন বা করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে নরওয়ে প্রশাসন। শেনগেনভুক্ত দেশের নাগরিক বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপিয় দেশের নারীদের নগদ অর্থে রাজি করিয়ে ‘ম্যারেজ সার্টিফিকেট’ বানিয়ে ভূয়া কাজের কন্ট্রাক্ট দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ইদানিং নরওয়েতে ঢুকছেন নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিকরা। এই তিনটি দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘আগন্তুক’ এখন স্থানীয় পুলিশ ও ইমিগ্রেশান বিভাগের সন্দেহের তালিকায়।

অসলোর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গত ক’দিনে এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে অন্যান্য দেশের সাথে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ি, বৈবাহিক সূত্রে সাম্প্রতিককালে সাইপ্রাস থেকে নরওয়েতে এসেছেন ১৯ জন বাংলাদেশি, যাদের সবাই বিবাহ বন্ধনে (!) আবদ্ধ হয়েছেন সাইপ্রাসের মাটিতে এবং তাদের সবার স্ত্রীরা রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার নাগরিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নরওয়েতে জমা হওয়া কাগজপত্র অনুযায়ি উক্ত ১৯ জন বাংলাদেশির মাঝে ১০ জনেরই বিয়ে পড়িয়েছেন একই ‘কাজি’।

অসলো ও নিকোশিয়ার নির্ভরযোগ্য সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, দু’টি দেশেই সংঘবদ্ধ দালাল চক্র সাম্প্রতিককালে ‘ফ্রড ইমিগ্রেশান’র এই বিশেষ পন্থা বেছে নিয়েছে। নরওয়ের রাজধানীতে সোমালিয়ান ও শ্রীলংকান চক্রের সাথে যোগসাজশে বেশ ক’জন বাংলাদেশি দালাল এই অপকর্মে লিপ্ত আছেন বলে জানা যায়। এদিকে অসলো পুলিশের ভাষ্যমতে, পূর্ব ইউরোপিয় দেশের নারীদের নরওয়েতে ‘বিবাহ’ করার প্রবণতা ইদানিং আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৈবাহিক সূত্রে নরওয়ের বাইরে থেকে স্বামীদের নিয়ে আসার আবেদন ২০১১ সালে যেখানে জমা পড়েছিল মাত্র ১৬৭টি, সেখানে গত বছর তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাড়তে বাড়তে বিষয়টি এখন রীতিমতো ‘মহামারি’ আকার ধারণ করেছে। চলতি বছর জমা হওয়া প্রায় ৬ শতাধিক আবেদন এখন সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই পরবর্তি নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক আবেদন ইতিমধ্যে পুলিশী অনুসন্ধানে ‘অস্বাভাবিক বিবাহ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন মনে করছে, পূর্ব ইউরোপিয় দেশের নারীরা অর্থের লোভে নরওয়েতে মূলতঃ ‘অ্যাংকর’ এর ভূমিকায় কাজ করছে ‘আগন্তুক’কে এদেশের রেসিডেন্স কার্ড পাইয়ে দেবার জন্য।

বিচার বিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরিত রিপোর্টে পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, পুরো ইস্যুটি আসলে একটি ‘বিশাল বিজনেস’ যা সংগঠিত হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে। অসলো পুলিশের ‘ইমিগ্রেশান এন্ড এডমিনিস্ট্রেশান’ বিভাগের অফিস ম্যানেজার ফ্রেডরিক পাওয়ার বলেন, ‘‘প্রচলিত আইন অনুযায়ি একজন নরওয়েজিয়ান নাগরিককে বিয়ে করার চেয়ে পূর্ব ইউরোপিয় দেশের একজন নারীকে বিয়ে করে নরওয়েতে ৫ বছরের রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। কারণ পার্টনার নরওয়েজিয়ান হলে বেশ কড়াকড়ি অথচ ভিনদেশি হলে সীমিত কন্ট্রোল।’’

অসলো পুলিশ কর্মকর্তা ফ্রেডরিক পাওয়ার আরো বলেন, ‘‘তাদের আবেদন মঞ্জুর হবে তখনই যখন তারা বৈধ কর্মসংস্থান এবং বিবাহের কাগজপত্রের সত্যতা প্রমাণ করতে পারবে। তবে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আবেদনকারীদের অধিকাংশই কর্মসংস্থান ও বিবাহ উভয় ক্ষেত্রেই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্রমাণ পেয়েছি, বাইরের দেশ থেকে নিয়ে আসা স্বামীকে নরওয়েতে রেখেই পূর্ব ইউরোপের নারীরা নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। আগন্তুকদের সাথে নারীদের যোগাযোগটি কারা ঘটাচ্ছেন বা কাদের মাধ্যমে ঘটছে তা উদঘাটনে যদিও আমরা এখনো ‘ব্রোকার’দের সব তথ্য হাতে পাইনি, তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি আমরা খালিচোখেই দেখতে পাচ্ছি।’’

পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, কথিত ‘বিবাহিত’ স্বামী-স্ত্রীরা প্রায়শঃই একই ভাষায় কথা বলছেন না এবং কথিত ‘বিবাহিতা’ নারী তার অরিজিন দেশের সাথে বরারবরই গভীর সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অসলো পুলিশ দৃঢ়ভাবে মনে করে, বাস্তব বিষয়টি হচ্ছে নারীরা নরওয়েতে এইসব বহিরাগতদের কাছ থেকে বেশ ভালো আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে দিব্যি এসব কাজ করে যাচ্ছে। বৈবাহিক কাগজপত্রের জোরে নরওয়েত অনুপ্রবেশের পর ঐসব স্বামীরা অসলোতে বিশেষ কিছু দালালের শরণাপন্ন হচ্ছে, যারা তাদের মক্কেলদের বৈধতার আবেদনপত্রের অনুকুলে ‘কাজের কন্ট্রাক্ট পেপার’ ম্যানেজ করে দিয়ে থাকে।

পুলিশের ভাষ্যে এও বলা হয়েছে, ভূয়া কাজের কন্ট্রাক্টগুলো মুলতঃ নরওয়ের বিভিন্ন অঞ্চলের গাড়ির ওয়ার্কশপ, ক্লিনিং প্রতিষ্ঠান, পরিবহন কোম্পানি ও গ্রোসারি স্টোরগুলো থেকেই দালালরা ম্যানেজ করে আসছে। এতো গেলো কথিত ‘স্বামী’ তথা পুরুষদের কর্মসংস্থান। অসলো পুলিশের রিপোর্টে কথিত ‘স্ত্রী’ তথা নারীদের কাজের মেয়াদকাল সম্পর্কেও সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘‘চুক্তিভিত্তিক বিবাহ পরবর্তি তাদের স্বামীরা নরওয়েতে ৫ বছরের স্টে পারমিট পাবার মধ্য দিয়েই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যবনিকাপাত ঘটে নারীদের এই বিশেষ ক্রিয়াকর্মের।’’

‘ফ্রড ম্যারেজ’ ইস্যুটি নরওয়ে পুলিশের নজরে আসার পর এ নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করে আয়কর ও ইমিগ্রেশান বিভাগ। তাদের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে কিভাবে প্রচলিত আইনের চরম অপব্যবহার করে নরওয়েজিয়ান ইমিগ্রেশানকে বোকা বানানো হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে তদন্ত-অনুসন্ধান থেমে নেই। নরওয়েজিয়ান ডিরেক্টরেট অব ইমিগ্রেশান (ইউডিআই) কর্তৃক ইতিমধ্যে অনেকের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবার পর তাদের নরওয়ে ছাড়তে হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, প্রশাসন যে বিষয়গুলো এখন খুব ‘টাইটলি কন্ট্রোল’ করবে তা হচ্ছে কথিত ‘স্বামী-স্ত্রী’র আবাসস্থল তথা রেসিডেন্স এবং যেখানে কাজ করছে বলে দেখানো হচ্ছে ঐসব যায়গা। নারীদের আইডেন্টিটি কার্ড এবং আগন্তুক পুরুষদের সাথে তাদের ম্যারেজ সার্টিফিকেটের সত্যতাও বিশেষভাবে যাচাই করা হবে এখন থেকে। আবেদনকারী নারী-পুরুষদের বিশেষ ‘ক্রস ইন্টারভিউ’রও মুখোমুখি করা হবে বলে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে। বৈবাহিকসূত্রে বৈধতা তথা রেসিডেন্স পারমিট সংক্রান্ত যে কোন আবেদন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা যথারীতি নরওয়েজিয়ান ডিরেক্টরেট অব ইমিগ্রেশান (ইউডিআই)’র হাতেই ন্যস্ত থাকছে।
(এএস/মে ৩১, ২০১৪)