মাদারীপুর প্রতিনিধি : এক সময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে মাদারীপুর জেলার খেজুর গুড় ছিল ঐতিহ্যবাহী। স্বাদে-গন্ধে ছিল অতুলনীয়। বর্তমানে অসাধু ও অতি মুনাফাখোর গুড় উৎপাদনকারীদের কারণে মাদারীপুরের খেজুর গুড় এখন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

দিন দিন গুড় উৎপাদনকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠায় গুড়ের হারানো ঐতিহ্য আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। ভেজাল গুড়ে এখন হাট-বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ওজন বৃদ্ধি করতে চিনি আর রং ফর্সা করতে মিশানো হচ্ছে বিষাক্ত সালফার। যে কারণে সুস্বাদু খেজুর গুড় এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫/২০ বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও নেওয়া হয়নি কোন আইনি ব্যবস্থা। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন ধরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। পাশাপাশি নানা প্রতিকুলতার কারণে জেলার খেজুর গাছের সংখ্যা আশংকাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় গুড়ের উৎপাদন ২০ ভাগে নেমে এসেছে।

এক সময় প্রতি বছর শীত মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গুড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান খুঁজে পেত ৩০/৩৫ হাজার মানুষ। এখন সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে।

তাছাড়া খেজুর গাছ থেকে যে পরিমাণ জ্বালানী পাওয়া যেত তাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর ৬ মাসের জ্বালানী চাহিদা মিটাতে পারতো। এখন আর সে অবস্থা নেই।

আরো জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী চার দশক আগে মাদারীপুর, কালকিনি, রাজৈর ও শিবচর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ খেজুর গাছ ছিল। তখন প্রতি শীত মৌসুমে এ সব খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ মণ গুড় উৎপাদন হয়েছে। সে সময় এর মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে অর্থাৎ প্রতি মণ ৪‘শ টাকা হিসেবে ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তখন এ জেলার গুড় এলাকার চাহিদা পূরণ করেও দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হতো।

মাদারীপুরের সুস্বাদু গুড়ের পাটালি, দানাদার ও ঝোলা (পাতলা) গুড়ের সুনাম ছিল দেশব্যাপি। কেউ কেউ শখ করে এখানকার গুড় বিদেশে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠাতেন। সে সময় উৎপাদনকারীরা গুড়ে ভেজাল দেওয়া চিন্তাও করতেন না।

কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো, ভেজাল ছাড়া ১ কেজি গুড়ও বাজারে পাওয়া যায় না। এলাকার সুনাম রক্ষায় কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। শুধু অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ভাবে চলতে থাকলে এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে সুস্বাদু খেজুর গুড়ের অস্তিত্ব। মানুষ ভুলে যাবে আবহমান বাংলার পৌষ-পার্বণের উৎসব আর শীতের পিঠা-পায়েসের কথা।

১৯৭৫-৭৬ সাল পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমাগত ঝড়, বন্যা, সিডর ও নদী ভাঙ্গনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে খেজুর গাছের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে জেলার ইটভাটির মালিক ও লাকড়ি ব্যবসায়ীরা ১০/১৫ টাকা মণ দরে খেজুর গাছ ক্রয় করতে থাকে। এভাবে ইট ভাটার জ্বালানীর চাহিদা মিটাতে উজাড় হতে থাকে খেজুর বাগান। চার দশক পর বর্তমানে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে ৩ লাখের নিচে। একই সঙ্গে গুড়ের উৎপাদন কমে এসেছে ৫ ভাগের ১ ভাগে।

গুড়ের উৎপাদন আশংকাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় গাছি ও গুড় উৎপাদনকারীরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় গুড়ে চিনি ও বিষাক্ত সালফার মিশিয়ে বাজারজাত করছে। এ কারণে আগের তুলনায় গুড়ের উৎপাদন কমেছে ৮০ ভাগ, অথচ দাম বেড়েছে ৮-১০ গুণ। ভেজাল গুড় ক্রয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণে ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পেয়ে বর্তমানে নেমে এসেছে ১৮-২০ ভাগে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর সদরের পুরাতন কোর্ট, পুরান বাজার, কুলপদ্মী, মাদ্রা, মস্তফাপুর, শিরখাড়া, কালিরবাজার, ত্রিভাগদি, শ্রীনদী হাট, কেন্দুয়া, কলাগাছিয়া, মঠেরবাজার, মাথাভাঙ্গা, আঙ্গুলকাটা, খেজুরতলা, ফরাজীর হাট, ছিলারচর, খেজুর বাগান, কালকিনির ঝুঁরগাাঁও, সাহেবরামপুর, ফাসিয়াতলা, খাশেরহাট, রমজানপুর, ভ’রঘাটা, গোপালপুর, শশীকর, নবগ্রাম, রাজৈরের টেকেরহাট, কবিরাজপুর, কদমবাড়ি, শাখারপাড়, শিবচরের বরহামগঞ্জ, উৎরাইল, কুতুবপুর, কাদিরপুর, শেখপুর, ভান্ডারীকান্দী নতুন হাট, চান্দেরচর, পাচ্চর, দত্তপাড়া, বাগমারা হাট বাজারে ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ২‘শ টাকা কেজি দরে। কোথাও খাঁটি গুড় পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গাছি ও গুড় ব্যবসায়ী বলেন, “ভেজাল ছাড়া এখন খাঁটি গুড় পাওয়া যায় না। খাঁটি গুড় পেতে হলে ৩/৪ দিন আগে আমাদের কাছে বায়না দিতে হবে। তবে সে গুড়ের দাম অনেক বেশি। প্রতি কেজি সাড়ে ৩‘শ থেকে ৪‘শ টাকা করে লাগবে।”

(এএসএ/এএস/জানুয়ারি ২৮, ২০১৬)