কক্সবাজার প্রতিনিধি : চিকিৎসকদের মতে তামাক রোপন থেকে শুরু করে পাতা কাটা এবং শুকানো পর্যন্ত এর সকল পক্রিয়াতে রয়েছে বিষাক্ত ছোবল। কৃষকরা ভয়াল এ বিষ সম্পর্কে জানার পরেও বার্তি লাভের আশায় এসবেই ঝুঁকছে বেশি। এর পরিচর্যায় কৃষকরা নিজেদের পাশাপাশি পরিবারের স্ত্রী ও কোমলমতি শিশুদেরও ব্যবহার করছে। ফলে বাড়ছে ক্যান্সার সহ তামাক জনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ।

এদিকে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে প্রশাসনের দফায় দফায় অভিযান ও জনসচেতনতামূলক একাধিক সভা সেমিনারের পরও ফসলি জমিতে বেড়ে চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ। উল্টো প্রশাসনের এসব নিদের্শকে তোয়াক্কা না করে প্রতিবছরের মতো এবছরও রেকর্ড পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ শুরু হয়েছে বিভিন্ন উপজেলার আবাদি জমি, মাতামুহুরী নদীতে জেগে উঠা চর ও বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পতিত জমিতে। চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বমু বনবিট ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের মানিকপুর বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং মাতামুহুরী নদী তীরের বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ও বান্দরবান জেলার লামা আলী কদম উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিপুল পরিমাণ খাস ও জোত জমিতে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চাষিরা তামাক চাষ শুরু করেছে বলে জানান স্থানীয়রা।

স্থানীয় সূত্র জানা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইতোমধ্যে বেশ ক’টি এনজিও সংস্থা কক্সবাজার জেলায় কাজ করলেও কৃষকের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধে কোন ধরনের আগ্রহ নেই। ফলে অনেকটা বিনা বাঁধায় স্থানীয় কৃষকদের জিম্মি করে প্রতারণার প্রলোভনে ফেলে ট্যাবাকো কোম্পানি গুলো প্রতিবছর তামাক চাষে বাধ্য করছে। অভিযোগ উঠেছে, অনেক এলাকায় জনপ্রতিনিধিরাও পরিবেশ বিধ্বংসী এ চাষকে সমর্থন দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, যারা তামাক গাছ লাগাচ্ছে। যারা তামাক বানাচ্ছে। নারানারি করার কারণে নিকোটিনের প্রভাবে স্কীন ক্যান্সার সহ না ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কৃষকরা বলেন, তামাক আসলেই ক্ষতিকর। কিন্তু অভাবের কারণে তামাক চাষ করেলে দুইটি টাকা পাওয়া যায়। এদিকে কৃষকরা আলু সহ অন্যান্য সবজি চাষে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবং তামাকে নিশ্চিত লাভ জেনেই জীবন বিনাশি এই আবাদে ঝুঁকে পড়ছেন বেশি। আমরা কৃষকরা দিন দিন জমি বন্ধক রেখে খাচ্ছি। এই কারণে আমরা বার্তি লাভের আশায় বাধ্য হয়ে তামাকের আবাদ করছি।

মানিকপুর ইউনিয়নের তামাক চাষি আবদুল্লাহ বলেন, তামাক চাষ অধ্যুষিত এলাকায় জমি মালিকরা রবিশস্যয ও ধান আবাদের জন্য সহজে জমি বর্গা দেয় না। কারণ এক কানি (৪০শতক) ফসলি জমি দুইসনা (এক বছর) লাগিয়ত দিয়ে ১০হাজার টাকা পেলেও একই জমি তামাক চাষের ক্ষেত্রে লাগিয়ত পায় ২৫ হাজার টাকা। ফলে কৃষকরা জমি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয়ে তামাক চাষের উপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে।

কৃষকরা আরও বলেন, বেসরকারি ট্যাবাকো কোম্পানি গুলো আমাদেরকে বীজ, সার, পলিথিন আরও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা এবং অগ্রিম টাকা দেয়। যার কারণে আমরা এ তামাক চাষ করি। আর কৃষি বিভাগও স্বীকার করলো তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলোও পণ্যের সঠিক দাম না পাওয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না তামাক চাষ।

কক্সবাজারের কৃষি কর্মকর্তা জানান, খাদ্য শষ্য বা রবিশস্য সবজির বাজার মূল্যটা কৃষককে দিতে পারি, তাহলে কৃষক ভবিষ্যতে এই জীবননাশি তামাক চাষ থেকে ফিরে আসবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উবিনীগ কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক রফিকুল হক টিটো বলেন, তামাক চাষের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে আবাদি জমি। তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির অনুজীব নষ্ট হচ্ছে এবং জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তি। পরবর্তীতে ওই জমিতে শত চেষ্টা করেও কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তিনি আরো জানান, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে তামাকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ সব পেশার নাগরিক এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই তামাক চাষ বন্ধ করা সম্ভব হবে।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের (ডিএফও) মো.শাহ-ই-আলম বলেন, বনকর্মীদের সর্তকতার কারণে বর্তমানে আগের মতো বনাঞ্চল উজার করে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের সুযোগ নেই। তবে অনেক স্থানে পাচারকারী চক্র নানা কায়দায় বনাঞ্চল উজার করে কাঠ নিধনে জড়িত থাকার বিষয়ে আমাদের কাছে সংবাদ রয়েছে। তিনি বলেন, বনজসম্পদ রক্ষার স্বার্থে তামাক চাষ অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে জোরালো অভিযান অব্যাহত রাখা হবে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম বলেন, মাতামুহুরী নদীর তীরে করা তামাক চাষ ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে এবার প্রশাসনের কড়া নজর থাকায় অনেক স্থানে তামাক চাষ কমে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, তামাক চাষে প্রথম দিকে কিছু নগদ আয়ের আকর্ষণ সৃষ্টি হলেও ধীরে ধীরে কৃষক বুঝতে পারেন তারা আসলে বাঁধা পড়ে গেছেন এবং নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। কৃষককে তামাক চাষের নগদ টাকায় বাজার থেকে চাল, শাক, সবজি, ডাল ইত্যাদি কিনে খেতে হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায়, তামাকের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ সারা বছরের খাদ্য কেনার জন্য যথেষ্ট নয়। দেনা শোধ করা এবং চিকিৎসা করতে গিয়েও অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই পরবর্তী মৌসুমের আগে কোম্পানি আবার তাকে যখন আগাম টাকা দিতে আসে, তখন সে টাকা নিয়ে সংসার চালায় আর পরের মৌসুমে তামাক চাষের জন্য দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি আবাদি জমিতে তামাক চাষের ফলে মাটি নষ্ট হয় এবং এ সার-বিষ গড়িয়ে আশপাশের পানিতে গেলে মাছ ও জলজপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়। তামাক ক্ষেতে বিষে আক্রান্ত কীটপতঙ্গ অন্যান্য প্রাণী খায় বলে তামাক চাষ এলাকায় পশু-পাখিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মৌমাছি, প্রজাপতি, কেন্ন, ঘাস ফড়িং, ব্যাঙ ও কেঁচোর মতো কৃষির জন্য উপকারী প্রাণিসম্পদ আমরা হারাতে বসেছি। কৃষকের বাড়িতে গরু-ছাগল, হঁসি-মুরগি পালন করা যায় না। তামাক চাষির বাড়িতে গরু-ছাগলের খাদ্য থাকে না। গরু-ছাগল মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান, তারা তামাক পাতা খায় না। ফলে দিন দিন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ বিভিন্ন পরিবেশগত রোগ ব্যধি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

(একেডিএইচ/পি/জানুয়ারি ২৮, ২০১৬)