ধামইরহাট (নওগাঁ) প্রতিনিধি : শীত যতই জেঁকে বসছে বনভোজনের আনন্দ আর ভ্রমণ বিলাসীদের পদচারণায় ধামইরহাটের পিকনিক স্পটগুলো ততোই মুখর হয়ে উঠেছে। কুয়াশা আর তীব্র শীত পিকনিক পার্টিগুলোকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। ছুটির দিনে শুক্রবার বনভোজন বিলাসীদের ভিড় বেশি। উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমি হিসেবে খ্যাত ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা নওগাঁর ধামইরহাটে অবস্থিত প্রায় দুইশ বছরের প্রাচীন এক শালবন।

এ বরেন্দ্রভূমির বিশাল শালবনটি ৬৫২একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত অর্থাৎ ১৯৫৬ বিঘা। এ প্রাচীন শালবনে শুধু শালগাছ নেই পাশাপাশি অন্য গাছেরও দেখা মিলে। প্রকৃতির অপূর্ব নিদর্শন আর চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের প্রাচুর্য নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চিরসবুজের নজরকাড়া সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে এই শালবনটি। তাই মন জয় করা এই শালবনে প্রান জুড়াতে আসেন দুর-দুরান্তের অনেক অনেক ভ্রমণ বিলাসী। এ পিকনিক স্পটগুলো ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আবাল বৃদ্ধ বনিতার কলকাকলিতে মুখর থাকে। এই বিশাল শালবনটিকে ঘিরে লুকিয়ে আছে দেশের পর্যটন ক্ষেত্রের বিশাল সম্ভাবনা।

এ শালবনটি গত ২০১১ সালে সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করেন। বনের পথ যেখানে শেষ সেখানেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। কাছাকাছি সীমান্তের পিলার। বেড়ার ওপারে দেখা যায় ভারতীয়দের কৃষি-কর্ম আর বিএসএফের টহল। এই বনের অন্যতম আকর্ষন শালগাছকে জড়িয়ে উঠে গেছে হিংলো লতা, অনন্তমূল ও বনবড়ইসহ নানা লতাগুল্ম আর বনফুল। বনের ভেতরে প্রবেশ করতেই নাকে ভেসে আসে নাম না জানা নানা রকমের বনফুলের মিষ্টি গন্ধ। আর মাঝে মাঝে আছে ঘন বেত বন। বেত গাছের সবুজ চকচকে চিকন পাতায় চোখ জুড়িয়ে আসে। এই বনে আছে সাপ, শিয়াল, খরগোস, বনবিড়াল, বনরুই ও বেজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রানী আর পাখি। পাখির কলতানে মুখরিত সমগ্র শালবন।

নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা বাসষ্ট্যান্ড থেকে ৬০কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যেতে হবে জেলার ধামইরহাট উপজেলা সদরে। পথে পড়বে মহাদেবপুর, পত্নীতলা উপজেলার সদর। ধামইরহাট থেকে মাত্র ৬কিলোমিটার পথ পেরুলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সাজানো নয়ন ভরা সেই প্রাচীন শালবনটি। ৬কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে লালমাটির রাঙ্গাপথ। দুরে থেকেই নজরে পড়বে সেই প্রচীন শালবনটি। বনের দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই অনুভূতি হবে রোমাঞ্চকর। পথের ধারে ছোট ছোট বসতবাড়ি সেগুলিতে আদিবাসীদের বসবাস। চোখে পড়বে বরেন্দ্রভূমির চারিদিকে শুধু উঁচু-উঁচু শালগাছ। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই শালবনটি যেন প্রকৃতির গোপন রহস্যে ঠাসা। এই বনভূমি সরকারের রির্জাভ ল্যান্ড ফরেষ্ট হিসেবে সংরক্ষিত। প্রাকৃতিক এই বনভূমির মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতা।

নওগাঁর বরেন্দ্রভূমি ধামইরহাট উপজেলার মশইর মৌজার বিশাল শালবনটি সত্যিই অবাক করার মতো। আরো কথিত আছে, এক সময় শালবনটির মালিক ছিলেন কলকাতার পাথরঘাটার জমিদার অত্যানন্দ ঠাকুর। তিনি দৈবক্রমে অন্ধ হয়ে যান। ফলে তার স্ত্রী অক্ষয় কুমারী দেবী জমিদারী পরিচালনা করতেন। উপজেলার আড়ানগরে তাদের কাছারীবাড়ি ছিল (বর্তমানে বাড়িটি তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে)। বুনোপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা মিলবে শালবনের মাঝে বিশাল টলটলে জলের আলতাদিঘি। দিঘির এই প্রাকৃতিক বনভূমির চারপাশে ঝোঁপঝাঁড়। প্রকৃতি এখানে নিজ হাতে যেন সবকিছু সাজিয়েছে। তাই এখানে প্রতিদিনই আসে অনেক দুরের ভ্রমণ বিলাসীরা। এক নজর দেখতে কেউ বা পিকনিক করতে। শালবনের মাঝে জায়গা করে নিয়ে বড় বড় ঢিবি গড়ে তুলেছে উইপোকা। যা নিজের চোখে দেখলেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না তবে তা সত্য। লালচে রঙ্গের এই ঢিবিগুলো প্রবল বর্ষনেও নষ্ট হয় না।

উইপোকারা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যায় সারা বছর। শালবনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সহযোগীতার জন্য ২৪ জন জনবল নিয়োজিত রয়েছে সর্বক্ষন। বর্তমানে এটি পর্যটন কেন্দ্র না হলেও প্রতিদিনই মুখোরিত হয় বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভ্রমণ বিলাসীদের পদচারনায়। প্রকৃতির বনভূমি শালবনে কোন বিশ্রমাগার না থাকলেও বনের উত্তর ধারে অনেকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যারা বেড়াতে আসেন তারা এ ফাঁকা জায়গায় বসে নির্মল বাতাসে আরাম করেন। অনেকে সেখানেই রান্না করে খাবারের পর্ব সারেন। শালবনে গেলে চোখে পড়বে চারিদিকে নিঝুম স্তব্ধতা।

দু’চোখে শুধুই সবুজ আর সবুজ। কানে আসবে জানা-অজানা পাখির ডাক। বরেন্দ্রভূমির এই প্রকৃতির রাজ্যে যারা আসবেন তাদের মন ভরে উঠবে প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সারাটা জীবন ক্ষনিকের এই স্মৃতি ডেকে ফিরবে বারং বার। কালুপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পিকনিকে বেড়াতে আশা কামরুন নাহার বলেন, এই স্থানটির কথা আমি বহুবার শুনেছি কিন্তু আসা হয়নি। তাই আজ এখানে এসে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না জেলায় এতো সুন্দর একটি শালবন রয়েছে। আর মাঝখানের দিঘিটি শালবনের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে।

এ বিষয়ে ধামইরহাট উপজেলার দায়িত্বে থাকা বনবিট কর্মকর্তা লক্ষন চন্দ্র ভৌমিক বলেন, ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য শালবনের জাতীয় উদ্যানটিতে ইতোমধ্যে ১৭০ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ওষুধি গাছ লাগানো হয়েছে। সেই সাথে বেতের বাগান করা হয়েছে। এই উপজেলা প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রতিদিন এই শালবন ও দিঘি দেখার জন্য শতশত লোকজন এসে থাকে বনভোজনের জন্য। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি এই উপজেলার চেহারাই পাল্টে যাবে এই শালবন ও দিঘি জন্য। এ পিকনিক স্পটের চারিদিকে সবুজ বনানীর মোহনীয় রূপ ভ্রমন পিয়াসীদেও পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।

(এএইচবি/এএস/জানুয়ারি ২৯, ২০১৬)