মাহবুব আরিফ : ২১শের শহীদ আর ভাষা সৈনিকদের সন্মান রক্ষার্থে আমাদের কি কিছু করণীয় আছে? আর যদি থেকেই থাকে আসুন সবাই মিলেই তা অনুধাবন করি।

ইউনেস্কো ১৭ই ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস স্বীকৃতি প্রদান করে, উদোক্ত হিসাবে কানাডা প্রবাসী কয়েকজন বাঙালীর নাম সালাম, রফিক ও বরকতের নাম চির স্বরণীয় হয়ে থাকবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই আদিবাসীদের ভাষা সংস্কৃতি ও জীবনধারা নিদৃষ্টভাবে আইনি সহায়তার মাঝে সুরক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সুইডেনের উত্তরে, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডের কিছুটা অংশে সোওয়ামি আদিবাসীদের বসবাস, ইউরোপে তাদের ল্যাপস পিপলও বলা হয়ে থাকে, তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উপর তাদের জীবনধারা নিয়েই এই জাতি ইউরোপের আদিবাসী হিসাবেই পরিচিত ও সোওয়ামি আদিবাসীদের ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক নিয়মাবলীর অধীনেই স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত, এবং অত:পর তারা ইউরোপ উত্তর আদিবাসী সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের জন্যে তাদের নিজেদের ভাষায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও সরবারহ করা হয়ে থাকে। সুন্দর বিষয়ে হচ্ছে তাদের নিজেদের জায়গা জমি তাদের একটি বিশাল ১৫০.০০০ বর্গ মাইল সীমারেখার তিনটি দেশের মাঝে নির্ধারণ করে সেটাকে তাদের আদি সম্পত্তি হিসাবেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা দিবস, আমরা আন্তর্জাতিক ভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সবার আবার নতুন করে ২১শে ফেব্রুয়ারির উপর ইউনেস্কোর দেয়া আইনি ব্যাখ্যা পাড়ার প্রয়োজন নাই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চাকমারা কি বাঙ্গালী নাকি চাকমা, তবে চাকমারা যে বাংলাদেশী সেটা সবারই জানা, তা হলে প্রশ্ন আসতে পারে সাঁওতাল, মং, মুরং এদের জাতিগত পরিচয় কি? আমার যদি এইসব গোত্র ও তাদের ভাষা, সাহিত্য, জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে না পারি তাহলে তো এইসব জাতিগুলো তিলে তিলে আমাদের মাঝেই ধংস হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।

চাকমা, সাঁওতালী, মনিপুরি, খাসিয়া ভাষায় আমাদের দেশে কি ফ্রিতে স্কুলের পাঠ্য পুস্তক বিতরণ করা হয় , চাকমা ভাষায় আমাদের দেশে প্রাইমারি বা উচ্চ বিদ্যালয় কয়টা? প্রশ্ন তো অনেকই করা যায় শুধু উত্তর কোথায় পাব সেটাই আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, দেশটা আমাদের সবার তাই সবাইকে সাথে নিয়েই সঠিক কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন আসে বিগত ১৮ বছরে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি কতটুক বাস্তবায়িত করতে পেরেছি? আমারা এখনও ঐ এলাকায় বসবাসরত মানুষদের কি ভাবে সম্বোধন করি? আদি বাসী নাকি উপজাতি? যদিও আমরা আইন করেই তাদের উপজাতি বলে থাকি কিন্তু এ বিষয়ে চকমা মং, মুরং তাদের মতামত ও দাবি নিয়ে অনেক প্রশ্নই অন্ধকারে রয়ে যায়।

একটি জাতি ও তার সংস্কৃতিকে সুরক্ষা করা আমাদের সবার মানবিক দায়িত্ব আর তা যদি সঠিক ভাবে পালন করতে না পারি তবে একটি ভাষা ও সংস্কৃতি পৃথিবী বুক থেকে হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো দ্বারা একটি সতর্কমূলক ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবী থেকে অর্ধেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, প্রশাসনিক ভাবে ব্যবহৃত প্রায় ৭৭২০টি ভাষার মাঝে এমন ২০০০টি ভাষা আছে যা নাকি শুধু মাত্র ১০০০ কি তারও কম মানুষ সেই ভাষাগুলোতে কথা বলে, সাব-সাহারান আফ্রিকা, ওশেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক কথ্য ভাষা অচিরেই হারিয়ে যাবার সম্ভবনা আছে যদি আমরা এখন থেকেই সতর্ক না হই। আমাদের দেশেও এ ধরনের অল্প ব্যবহৃত ভাষা ও সংস্কৃতিগুলোকে সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বৈকি আর তা যদি আমরা করতে না পারি সেটা হবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

বাংলাদেশ পৃথিবীর এমন একটি দেশ যে দেশে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের জন্যে বিষয়টি গর্বেরও বটে কিন্তু আমাদের অনেকের মনের মাঝে নানা ধরনের প্রশ্ন আসতেই পারে, সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার চেষ্টা করছি মাত্র। বিলুপ্ত প্রায় ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কতটুকু আমরা কি সব ভাষাতেই বই ছাপাতে পারছি বা অনুবাদ করতে পারছি? চাকমা, মারমা, মরুং, খাসিয়া ও মোথাই বা মনিপুরি ভাষাগুলোর উপর আমাদের এখনি নজর দেয়া উচিত কারণ এই ভাষাগুলো তাদের নিজেদের বর্ণমালা দিয়ে সুসজ্জিত এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিতভাবে বিপন্ন প্রায় ৭টি কি ৮টি ভাষাকে রক্ষা করার খুব একটা সহজ বিষয় বলে মনে হয় না কারণ এমন সব ভাষায় কথা বলার মত লোকজন জীবিত আছে ২০ থেকে ১২০০ জনের মত। ভাষা বিলুপ্ত হবার অনেক কারণ থাকতে পারে তার মাঝে একটি হচ্ছে অবহেলা অপরটি আগ্রাসন, এক্ষেত্রে আমার যদি এ ভাবে বলি যে বাংলা ভাষার আগ্রাসনে অন্য বিলুপ্ত প্রায় ভাষাগুলি হুমকির মুখে পড়েছে তাহলে অন্যায় কিছু বলা হবে কি? অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণেও ভাষা হুমকির মুখে পড়ে যায়, এ ক্ষেত্রে আমি খুবই হৃদয় বিদারক একটি সময় ও ঘটনার কথা বলছি বিগত কয়েক বছর আগে ২০১০ সালে সুনামির কারণে আন্দামান দীপপুঞ্জে বংশের শেষ মানুষটি, নাম বোয়া সিনিয়র, তিনি ছিলেন আন্দামানবাসী একটি উপজাতিও ভাষায় কথা বলা শেষ মানুষ , ৮৫ বছরের এই বৃদ্ধা মারা যান আর সেই সাথে একটি একটি ভাষায় কথা বলা শেষ মানুষটির সাথে একটি ভাষাও চিরতরে এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়।

অনেক সময় সংস্কৃতির উপর আগ্রাসনের কারনেও ভাষার উপর আক্রমণ হয়, যেমন ধরুন বাংলা ভাষাতে সবার অগোচরেই খুব নীরবে আরবী ভাষার অনেক শব্দ জায়গা করে নিচ্ছে যেখানে দেশীয় ভাষায় শব্দগুলো অদৃশ্য হয়ে নতুন অভিব্যক্ত নতুন ভাষায় ব্যবহার করা হচ্ছে, এটাকেও ভাষার উপর এক ধরনের আগ্রাসন বলা যেতে পারে | ভাষা পরিবর্তনশীল যা আমাদের সবারই জানা তাই বলে অন্য একটি ভাষা আমাদের বাংলা কথ্য ভাষার উপর আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে সেটা কি সহজে মেনে নেয়া যায়?

বিবিসি’র একটি গবেষণায় বলা হয় পৃথিবী থেকে আনুমানিক ২৫টির মত ভাষা প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে , একদিন হয়তো আমাদের দেশের কোন একটি অঞ্চল থেকে একটি ভাষা আমাদের সব অগোচরে হারিয়ে যাবে আর সেটা হবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

পরিশেষে আমার একটি অনুরোধ আমরা মানুষ আর সব জাতি ধর্ম মিলেই এই দেশে বসবাস করছি আর তাই অন্য একটি জাতি ও ভাষাভাষীর মানুষদের জোর করে বাঙালী বানিয়ে রাখতে গেলে মানবাধিকার ক্ষুন্ন করা হয়, তাই আসুন আমরা সতর্ক হই।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী