নাটোর থেকে মামুনুর রশীদ : নাটোরের হালতিবিলের বিশাল জলরাশি এখন ফসলের মাঠ। মাত্র দেড় মাস আগেও ছিল বিশাল জলরাশি। চারিদিক ছিল অথৈ পানি। অথচ চারদিকে এখন বিরাজ করছে কচি সবুজ পাতার সমারোহ।

বাতাসে সবুজ আলোর ঢেউ খাচ্ছে। আর বিলের বকু চিরে কংক্রিটের ডুবো সড়ক, দ্বীপের মত ছোট ছোট গ্রাম। মাঝে কোথাও কোথাও কালচে সবুজের হাতছানি। মাঝে মধ্যে দু’একটি বড় আকারের পুকুর, পুশকুনি। পুকুরে ভাসছে সুদৃশ্য নৌকা। দু’চোখ যতদূর যায় সবুজ মিশেছে যেন আকাশ সীমায়। এটা শুকনো মৌসুমের রূপ। আর বর্ষায় থাকে এর ভরা যৌবন। তখন এর নাম থাকে ‘মিনি কক্সবাজার’।

সে সময় ১০-১২ফুট পানি যখন জমে তখন প্রতিটি গ্রামই যেন হয় একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনে হয়। ওই সময় গ্রামের মানুষের নিদারুণ কষ্টে কাটলেও পর্যটকদের কাছে তখন এটি মিনি কক্সবাজার সৈকত। ঠিক সৈকত না থাকলেও টইটুম্বুর পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোকে কক্সবাজারে বেড়ানোর সঙ্গে তুলনা করতেই পছন্দ করেন দর্শনার্থীরা। বর্ষায় মাছ শিকার ও নৌকা চালানো এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষের প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়ায়।

বিলের অধিকাংশ জমিই ব্যক্তি মালিকানাধীন। প্রত্যেকের জমি একেবারে কম নয়। এক ফসলি জমির আয় দিয়েই চলেন এখানকার বাসিন্দারা। তবে বর্ষায় হাজার হাজার পর্যটক এদিকে আসায় নতুন আশা দেখছেন গ্রামবাসী। তাদের কক্সবাজারে এখন পানি না থাকলেও পরিকল্পনা থেমে নেই। সরকার যখন ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করেছে, তখন এখানকার বাসিন্দারা নতুন আশায় বুক বাঁধছে।

স্থানীয়রা জানায়, মাত্র কয়েক বছর আগেও হালতিবিল ও আশেপাশের গ্রামের মানুষকে ধানসহ উৎপাদিত পন্য নিয়ে হাটে যেতে হতো পায়ে হেঁেট আর মাথা কিংবা ঘারে করে । কখনও রোদ-বৃষ্টি, কাদা, কখনও বা ধুলোবালিতে লুটোপুটো খেতে হতো তাদের প্রতিনিয়িত। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়নি। দুর্ভোগ যেন সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছিল বিলপাড়ের মানুষের। কিন্তু এখন বিলাঞ্চলের মানুষের দিন পাল্টে গেছে। হালতিবিল ও বিলসংলগ্ন গ্রামের মানুষ দিন বদলের আশা নিয়ে ধান, পিয়াজ, রসুন, আলু, পাটসহ বিভিন্ন পন্য উৎপাদন করছে। সেই কৃষিজাত পন্য গাড়িতে নিয়ে হাটে-বাজারে ও দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে ছুটছে অনায়াসে। ফসলের ন্যায্য মুল্যও পাচ্ছে খুব সহজেই। ঘর থেকে বের হলেই পা রাখছে পাকা সড়কে। কাদা বা ধুলোমাটির দিন এখন শেষ। চাইলেই স্কুটার, অটোরিক্্রা, কার, বাস ও মোটর সাইকেল নিয়ে সহসায় যাতায়াত করছে এখানকার মানুষ।

জানা যায়, নাটোর সদর উপজেলার অন্তর্গত হালতি বিলের আয়তন প্রায় ১০০বর্গ কি.মি.। এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখের কাছাকাছি। শতকার ৯৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে এবং তাদের জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কৃষি ও কৃষি ভিত্তিক কর্মকান্ড। এই বিলে প্রায় ৪১ হাজার ৪৩২ একর জমি রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে হালতিয়া পাখির আবাস ছিলো বলেই সেখান থেকেই নাম এসেছে হালতি। এই কারনেই বিলের নাম হয়েছে হালতিবিল। তবে এটা চলনবিলের একটা অংশ। বিলের মাঝখানে ৫টি গ্রাম একে দিয়েছে অসামান্য সৌন্দর্য। খোলাবাড়িয়া, হালতি, দিঘিরপাড়, কুঁচকুড়ি ও একডালা। তবে এদের প্রাণ আবার খোলবাড়িয়া গ্রাম।

এই গ্রামেই রয়েছে হাইস্কুল, মাদ্রাসা, পোষ্ট অফিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। সবগুলোই দ্বীপগ্রাম। বর্ষায় ১০-১২ফুট পানি যখন জমে তখন প্রতিটি গ্রামই হয় একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর গ্রামগুলির ঘরবাড়ি ছাড়া সকল ফসলের জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তিন-চার মাস বিলে পানি থাকে। বর্ষাকালে নৌকাই একমাত্র যাতায়াতের পথ। বর্ষায় কেউ কেউ মাছ ধরেন। কেউ আবার পর্যটকদের নৌকা নিয়ে ঘুরিয়ে চালান সংসার। তবে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা এসময় বসে কাটান। নৌকাই তাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম তখন। রাস্তা থাকলেও তা ডুবে থাকে তিন থেকে চার ফুট পানির নিচে।

আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হেটে চলাচল করতে হয়। শুস্ক মৌসুমে বিলের সমস্ত খাল ডোবা বা জলাশয় একেবারে শুকিয়ে যায়। এই বিলের বি¯তৃর্ণ মাঠে বছরে একটি মাত্র বোরো ফসল ভাল হয়। তবে এখন দিন বদলের আশা নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উৎসাহে হালতি বিলের কৃষকরা বিভিন্ন রকম ফসল যেমন গম, ভুট্টা, কাদায় রসুন, পিঁয়াজ, সরিষা, পিঁয়াজবীজ, বাদাম চাষ করছে।

এছাড়া হালবিলের গ্রামগুলোতে সবার বাড়ির সামান্য জায়গাটুকুসহ বাড়ির ঢালের ১০ হাত জমিও কেউ খালি রাখেন না এখানকার মানুষ। গায়ে গা ঘেঁষা বাড়িগুলোর সামান্য ফাঁকা জায়গাতে লাউ, কুমড়া ও পুঁইমাচা, বেগুন, টমেটো, পালং লাগিয়ে ফসল ফলানোয় চেষ্টায় ত্রুটি নেই। বিক্রির চেয়ে নিজেদের চাহিদা মেটানো এখানকার মানুষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ভালোই কাজে দেয় সময়-অসময়ে।

আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় এই এলাকার কৃষকেরা ধান সহ উৎপাদিত কৃষিপন্য স্থানীয় হাট বাজারে কম দামে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। সার, তেল সহ কৃষি উপকরণ মাঠে পৌছাতেও বেশি খরচ পড়তো। জেলা ও উপজেলা সদরে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতে সারাদিন ব্যয় হতো। কিন্তু সড়ক নির্মানের পর বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। পরিবহন সুবিধা বাড়ায় শহরে যাতায়াতে এখন সময় লাগে মাত্র এক ঘন্টা। বর্তমানে এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। হালতি বিলের মানুষের মধ্যে জন্মভিটা ছেড়ে অন্যত্র ছেড়ে যাওয়ার মানসিকতা হ্রাস পেয়েছে। প্রভুত উন্নতি হয়েছে খাজুরা, চাঁদপুর ও মহিষডাঙ্গা বাজারের।

প্রধান সড়ক থেকে খোলাবাড়িয়া গ্রামের মানুষের যাতায়াতে সংযোগ সড়ক নির্মান করা হয়েছে। এলাকায় বেকারত্ম অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। কৃষি উপকরন সরবরাহ ও উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাত করনে বৈপ্ল­বিক পরিবর্তন ঘটেছে। খোলাবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল আজিজ জানান, তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তার বাড়িতে যেতে আর কাদা ভাঙ্গতে হবে না। খাজুরা গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, সাবমারসিবল এসব সড়ক নির্মান করায় গৌরিপুর, মহিষডাঙ্গা, চাঁদপুর, কুঁচকুড়ি, দিঘিরপাড়, একডালাসহ এই অঞ্চলের অবহেলিত কয়েকটি গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনে প্রত্যাশা পুরন হয়েছে।

খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক তাহের উদ্দিন জানান, জমি রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ বিঘার মতো। এখন ব্যস্ত সময়। বছরের খোরাকি হবে,বোরো চাষে। আউশ-আমন ফলানোর সুযোগ আর নেই। তাই মাঠজুড়ে এখন বোরোর চাষাবাদ এবং চলছে অবিরাম চলছে মোটর। সেচযন্ত্র বলতে সবই বৈদ্যুতিক মোটর। শ্যালো চালিত মেশিনের সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল। বিলটি বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকলেও শুষ্ক মৌসুম এলেই পানির স্তর থাকে বেশ নিচে। ফলে কৃষকদেরকে চৈত্র মাসের দিকে সেচ কিছুটা বিপত্তিতে পড়তে হয়।

আরেক কৃষক আশরাফুল ইসলাম জানান, আত্রাইয় এলাকার রাবার ডাম্প সংস্কার অথবা উদয়পুর এলাকায় নদীর ভাঙ্গন যদি ঠেকানো যায় তাহলে বিলের পানি আরও আগে নেমে যাবে। তখন দুই ফসল করাও সম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমিকা বেশি।

স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিলঘেঁষা বারনই নদীর সঙ্গে যুক্ত আত্রাই নদী। আত্রাইয়ের রাবার ডাম্প ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের যদি সংস্কার করা যায় তাহলে এ এলাকার মানুষ অনন্ত দুই ফসলি জমি পাবে। তবে বিখ্যাত চলনবিলের অংশ হালতির স্বাভাবিকতায় কিছুটা ছেদ পড়তে পারে বলেও তারা মনে করেন।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডঃ আলহাজ উদ্দিন জানান, হালতিবিলে এখন শুধু বোরো চাষ হয় না। এখন পিঁয়াজের বীজ, পিঁয়াজ, ভুট্রা, গম, সষিরা, মুগ, কাদায় রসুনসহ নানা রকম ফসল চাষ হচ্ছে।

পরিকল্পিত ভাবে বিলে বন্যা নিয়ন্ত্রসহ পানি নিষ্কাষন এবং ভু-উপরিস্থ পানি সাশ্রয় করতে পারলে শুধু শুকনো মৌসুমেই নয় বর্ষা মৌসুমেও আমন-আউশ ধান চাষ করা যাবে। তবে ইতিমধ্যে হালতি বিলের কৃষকরা ভু-গর্ভস্থ ও ভু-উপরিস্থ পানি সাশ্রয়ে কৃষকরা বিকল্প ও লাভজনক ফসল চাষ করছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হেলালুর রশীদ জানান, হালতিবিলের মাঝে খাল বা জলাশয় গুলি খনন করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ভু-গভস্থ পানির ওপর চাপ কমে যাবে। এছাড়া বারনই ও আত্রাই নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমে প্রবেশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে কৃষকর সেচ নিয়ে আর কোন বিপত্তি হবে না।

স্থানীয় খাজুরা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জহুরুল ইসলাম ভুট্রু ও পিপরুল ইউপি চেয়ারম্যান দেব জ্যেতি দেব দেবু জানান, ইতিপুর্বে হালতি বিলের উন্নয়নে বিলহালতি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল হালতি বিলকে বন্যামুক্ত রেখে একই জমিতে একাধিকবার ফসল উৎপাদন এবং পানি সংরক্ষণ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আরো উদ্বৃত্ত ২৩ হাজার মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন সহ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং হালতি বিল এলাকার ৩ থেকে ৪ লাখ মানুষের খাদ্য চাহিদা সহ জীবন জীবিকার উন্নয়নে সহায়ক হবে। এমনকি দেশের অর্থনীতিতে এবং খাদ্য চাহিদায় বিরাট ভূমিকা রাখবে।

(এমআর/এএস/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৬)