নিউজ ডেস্ক : চট্টগ্রামে অফিস পাড়ার প্রম্পটিং করে উঁচুতে বাঁধা অভিনয়, দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্যে একটু নাচ-গান, একটু ভাঁড়ামি পূর্ণ গতানুগতিক নাটকে আর মন ভরছিল না রবিউল আলমের।

আসকার দীঘির পাড়ের পূরবী সংসদ তখন গান-বাজনা, সমাজ সেবা, বার্ষিক নাটক করে চট্টগ্রাম শহরে বেশ আলোচিত। কামরুল ইসলাম খোকা একদিন কাজির দেউড়ির চায়ের দোকানে পূরবীর বার্ষিক নাটকের পরিচালক আলী আনোয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি উৎপল দত্তের সঙ্গে গণনাট্য সংস্থায় কাজ করতেন।

আলী আনোয়ার সোজাসুজিই বললেন, ‌‘মজা পেতে হলে, নিজেদের একটা দল তৈরি করতে হবে।’ অতঃপর শুরু হলো আলোচনা। চায়ের দোকানে, এ বাসায় ও বাসায়, গলির মাথায়, মাঠের কোনায়। আলী আনোয়ার একদিন তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নী খালেদা ফেরদৌসকে আনলেন। তিনি শিক্ষকতা করেন বাওয়া স্কুলে আবার বেতারে খবরও পড়েন। রবিউল আলম আনলেন তার সহকর্মী প্রকৌশলী কামাল উদ্দিনকে। এই পাঁচ জনের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভাটি হলো কামরুল ইসলাম খোকার দামপাড়ার বাসায়। সিদ্ধান্ত হলো, নাটকের দল করব। সাত দিনের মাথায় ১৬ই মে, ১৯৭৪ সালে আবার যখন বসা হলো তখন আলী আনোয়ার দলের জন্যে নাম আনলেন তির্যক নাট্যগোষ্ঠী। আর রবিউল আলম লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন জননীর মৃত্যু চাই নাটকের পান্ডুলিপি।

পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলো, আলী আনোয়ারকে। একে একে এসে গেল সব তরুণ তুর্কিরা হাবিব উল্লাহ দুলাল, জাহাঙ্গীর কবির বাবুল, কাজী রফিক, ইশতিয়াক বাবু, স্বপন, মুকিমকে, আজাদ, দীপক সাহা ও রঞ্জন। এদের নিয়ে জননীর মৃত্যু চাইয়ের প্রথম মঞ্চায়নটি হলো, সি এন্ড বি মঞ্চে- ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে। এভাবেই চট্টগ্রামের দ্বিতীয় দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল তির্যক নাট্যগোষ্ঠী।

তির্যক নাট্যগোষ্ঠির ৪০ বছর উদযাপন
১৯৭৪ থেকে ২০১৪ সাল, কমিটেড শিল্প সাধনায় তির্যক নাট্যগোষ্ঠী পার করেছে মঞ্চসরব ৪০ টি বছর। নাগরিক ব্যস্ততায় ক্রমশ দুরুহ হয়ে আসা দায়বদ্ধ থিয়েটারচর্চায় যেটা সহজ ব্যাপার নয়। অর্জনের এই প্রেক্ষাপটে জেলা শিল্পকলা একাডেমী, চট্টগ্রামে ১৬-২১ মে, ২০১৪ পর্যন্ত ‘সৃষ্টিতে গৌরবে শিল্পিত ৪০’ শীর্ষক ছয় দিন ব্যাপী নাট্য উৎসব হয়ে গেল। ১৬ মে, বিকাল ৫টায় উদ্বোধনী পর্বে উদ্বোধক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভপতিমন্ডলীর চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকী। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সি.ইউ.জে) এর সভাপতি ও দৈনিক পূর্বকোন এর ফিচার সম্পাদক এজাজ ইউসুফী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কুন্তল বড়ুয়া,বিশিষ্ট সমাজসেবী ও দৈনিক মুক্তবানী পত্রিকার প্রকাশক ববিতা বড়ুয়া এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বিভাগীয় সম্পাদক (চট্টগ্রাম) সাইফুল আলম।

উদ্বোধনী দিনে মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমী চট্টগ্রামের শিল্পীবৃন্দ। মিলনায়তনে লোক নাট্যদল (ঢাকা) মঞ্চস্থ করে ‘কঞ্জুস’ নাটকটি। ১৭ মে, অরিন্দম ‘কবি’ ১৮ মে, উত্তরাধিকার ‘মন তার শঙ্খিনী’, ১৯ মে, তির্যক নাট্যগোষ্ঠী ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’, ২০ মে, ‘দ্যা ফাদার’, ২১ মে, গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় ‘কমরেডস্ হাত নামান’ মঞ্চস্থ করে। প্রতিদিন মুক্ত মঞ্চে ছিল স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ড্যান্স, স্কুল অব ফোক ড্যান্স, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, নরেন আবৃত্তি একাডেমী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের মূকাভিনয়, সঙ্গীত ভবনের পরিবেশনা। ২য় দিন চট্টগ্রামের নাট্য ও সংস্কৃতজনদের দৃষ্টিতে তির্যকের ৪০ বছরের নাট্যযাত্রা নিয়ে নির্মিত তির্যক ডকুমেন্টারী ‘সৃষ্টিতে গৌরবে শিল্পিত ৪০’ ও ৫ম দিন তির্যক নাট্যগোষ্ঠী’র পথনাটক ‘লজ্জা’ প্রদর্শিত হয়।

বর্নিল মুখোশ আর নাট্য চরিত্রের আদলে স্থাপিত কাঠের মুর্তি দিয়ে সাজানো পুরো শিল্পকলা প্রাঙ্গন যেন পরিনত হয়েছিল স্মৃতি আর শিল্পের মিলন মেলায়। মুক্তমঞ্চের অনুষ্ঠানমালার ফাঁকে ফাঁকে তির্যকের নাটক আর বিভিন্ন সময়ের ছবি প্রজেক্টরে দেখানোর সময় তির্যক সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরাও নাট্যভ্রমনে ঘুরে আসেন সত্তর দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত। মাঠের কোনায় রাখা স্বাক্ষর বোর্ডে দলের সদস্যদের ভালোবাসা আর কমিটমেন্টের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায় দর্শক শুভানুধ্যায়ীদের আকুন্ঠ ভালোবাসা আর সমর্থন। প্রচন্ড গরম আর কাল বৈশাখীর আশংকা নাট্যকর্মী আর দর্শকদের উপস্থিতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি যা থিয়েটারের শক্তিকেই আবার প্রমান করেছে।

চার দশকে ৩২ নাটকের সহস্রাধিক মঞ্চায়ন
১৯৭৪ সালে যাত্রা শুরু করে আজ পর্যন্ত তির্যক নাট্য গোষ্ঠী, তার প্রযোজিত ৩২ টি নাটকের প্রায় সহস্রাধিক মঞ্চায়ন সম্পন্ন করেছে। নাট্যকার সৃষ্টির অঙ্গীকারে তির্যক প্রযোজিত নাটকের অধিকাংশ অর্থাৎ ৩২ টি নাটকের মধ্যে ১৫ টি নাটকই দলের নিজস্ব নাট্যকার এর মৌলিক, তিনটি অনুদিত নাটক এবং দুইটি গল্পের নাট্যরূপ। নাট্য প্রযোজনায় বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী বলেই তির্যক নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় নাট্যকার ছাড়াও দেশ বিদেশের নন্দিত নাট্যকারের নাটককে প্রাধান্য দিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রযোজিত নাটকের নাটকের নাট্যকার - রবিউল আলম, আলী আনোয়ার মোল্লা, হাসনাত আবদুল হাই, আবু রুশদ, আবু নাসের ফেরদৌস, মিখাইল শ্চেদ্রিন, মুনীর চৌধুরী, কাজী জাকির হাসান, সেলিম আল দীন, বার্টোল্ট ব্রেখট, বাদল সরকার, আন্তন চেখভ, সফদর হাশমী, ওলে সোইঙ্কা, সাইদ মাহমুদ, উইলিয়াম শেক্সপীয়ার, শেখর সমাদ্দার, দারিয়ো ফো, অসীম দাশ, রফিউল কাদের রুবেল।

তির্যক-এর ৪০ বছরের কর্মযাত্রা
প্রকৃত নাট্যকর্মী সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে তির্যক নাট্য গোষ্ঠী বিভিন্ন নাট্য কর্মশালা, সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ শে মে আয়োজিত সেমিনার ও আলোচনা সভা। এতে বাংলা নাটকের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে ‘বাংলা নাটকে লোক আঙ্গিকের প্রয়োগ ভাবনা’ এবং ‘লোক সংস্কৃতি ও নাট্য আঙ্গিক’ শীর্ষক দু’টি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের অরুন মুখোপাধ্যায় এবং এদেশের সাজেদুল আউয়াল।

এছাড়া নাট্যকর্মীদের রাজনীতি সচেতন করার লক্ষ্যে ২৮শে সেপ্টেম্বর’ ৯৩ইং শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে আয়োজিত হয় ‘বাংলা নাটকে রাজনীতি’ শীর্ষক একটি সেমিনার এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন জনাব শান্তনু কায়সার এবং ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘৯৩ ইং উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত স্মরণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ফসল গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তির্যক প্রযোজনা করে মুক্ত নাটক ‘সোয়াত জাহাজ’৭১’। তির্যক নাট্য গোষ্ঠী প্রযোজিত প্রচুর আলোচিত নাটকের মধ্যে ‘আততায়ী’ অন্যতম। এই নাটকের মাধ্যমে চট্টগ্রামের নাট্য আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। উল্লখ্য, বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক সরাসরি মঞ্চনাটক সম্প্রচার অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিন ১৩ই জুলাই, ১৯৮৪ ইং এই নাটকটি সম্প্রচারিত হয়। ১৯৯৭ সালে আবার নতুন করে মঞ্চ নাটক সম্প্রচারের অনুষ্ঠান শুরু হলে, চট্টগ্রাম থেকে প্রথম নাট্যদল হিসাবে তির্যক নাট্য গোষ্ঠীর রবিউল আলম রচিত এবং খালেদ হেলাল নির্দেশিত নাটক ‘বিপক্ষে বন্দুক’ প্রচারিত হয় ২৪শে অক্টোবর, ‘৯৭ সালে।

১৯৭৭ সালে তির্যক নাট্য গোষ্ঠী কর্তৃক চট্টগ্রামে প্রথম একটি নাট্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘তির্যক’ প্রকাশিত হয়। যা ছিল সত্যিই একটি প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ। তিন বছর এই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। শিশু কিশোরদের নাটকের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ১৯৭৭ সালে ‘তির্যক লিটল থিয়েটার’ নামে চট্টগ্রামে প্রথম শিশু নাট্য কার্যক্রম শুরু করে এবং এই পর্যায়ে তির্যক তিনটি নাটকের এগারটি প্রদর্শনী সফল ভাবে সম্পন্ন করে।

চট্টগ্রামের নাট্য চর্চাকে আরো বেগবান করতে তির্যক নাট্য গোষ্ঠী তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে নাট্য উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। তাই চট্টগ্রামের নাট্যকর্মী ও দর্শকের কাছে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন সময় আমন্ত্রন করেছে দেশ বিদেশের উল্লেখযোগ্য নাট্যদলের সফল প্রযোজান।

১৯৮৯ সালের ৩০ ও ৩১ শে জানুয়ারী, শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে পশ্চিম বঙ্গের অন্য থিয়েটার বিভাষ চক্রবর্তী নির্দেশিত নাটক ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ পরিবেশন করে। ১৯৯০ সালের ১ ও ২ ফেব্রুয়ারী দিল্লীর ‘নয়া থিয়েটার’ লোকজ নাটকের সফল নির্মাতা হাবিব তানভীরের নাটক ‘চরণ দাশ চোর’ ও ‘আগ্রাবাজার’ প্রদর্শন করে মুসলিম হল মঞ্চে। তাছাড়া বিশ্ব নাট্য জগতের কালজয়ী নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখট এর ৯২ তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে তির্যকের আয়োজনে ৮ থেকে ১০ ই ফেব্রুয়ারী’ ৯০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম ব্রেখট উৎসব। এতে ব্রেখটের নাটক সৎ মানুষের খোঁজে, ধূর্ত উই ও সমাধান পরিবেশন করে যথাক্রমে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা থিয়েটার এবং তির্যক নাট্য গোষ্ঠী। এতে নাট্যজন জামিল আহমেদকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়াও ছিল প্রদর্শনী এবং আলোচনা সভা।

তির্যক নাট্য গোষ্ঠী চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, মাইজদী, চাঁদপুর, কক্সবাজার - এ নাটক প্রদর্শন করে প্রচুর দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে এবং অনেক প্রশংসিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত জাতীয় নাট্য উৎসব ‘৯২ সালে তির্যকের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটক বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা কর্তৃক শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার মতামত লাভ করে।

৪০ বছরের পথ হেঁটে এবার সম্মুখে যাত্রা
চুয়াত্তরের জন্ম লগ্নে তির্যকের শপথ ছিল নাটক চাই, নিয়মিত পাদ প্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াতে চাই, অবক্ষয় হতাশা থেকে মুক্তি চাই, নাট্যকার এবং নাট্যকর্মী সৃষ্টি করতে চাই, প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করতে চাই, নাটকের দর্শক সৃষ্টি করতে চাই। এখনও তির্যক এই প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান। যদিও প্রত্যাশার পূর্ণতা এখনো অনেক দূরে। তির্যকের পথ চলায় তাই আজো বিরাম নেই। নানা বিধি নিষেধ সংকট ও অভাব এবং প্রচন্ড নৈরাশ্য বার বার চলার পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তবুও তির্যকের সান্ত্বনা এই, তারা থামেনি। অনেক ‘না পারা’ কে জয় করতে তির্যক সহৃদয় দর্শকের শুভাশীষ চায়। তির্যক আজো নাটকের মুকুরে স্বরূপ দর্শনে নিষ্ঠাবান।