শিল্পস্রোত
কবি নাজমুল হক নজীর এর কবিতা
তীর্থে চলো সুদর্শন
যখনই কিছু বলতে যাই তুমি শুধু রাঙাও চোখ
মনে হয় আজ তাবৎ পৃথিবীর পরিত্রাণের ভাষা
আমার কাঁধে তুলে দিয়েছে সমস্ত লোক।
আমি যেন যীশু, বুদ্ধ কৃষ্ণ মোহাম্মদ কিংবা মুসা
সংস্কারে নামবো ভাঙ্গবো আঁধার সব !
আমি তো কবি হাতে দন্ড নেই, দন্ডাদেশ নেই
দেখি লোকালয় জুড়ে কেবলি কোলাহল কলরব
শকুনের পাখার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই ।
আমি বলতে পারবো না নুহের প্লাবন হবে কী, আর
কুরুপান্ডব যুদ্ধ, রুক্ত নামবে কী না ফোরাতের তীরে
তবু বুঝি একটা কিছু হবে এবং হওয়া দরকার
শুদ্ধি অভিযানে সুদর্শন হাসবে ঘরে ঘরে।
দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি
আজ তো আমার সেই সময় যখন জন্মদাতাকে
মনে হয় পরম শুত্রু
কামুক রমনীর কাছে
মুখোস্ত করতে হয় ভালবাসার পাঠ।
এ সময় আমাকে কেউ কবিতা লিখেতে বলো না
আজ তো দেশপ্রেম আনে শ্লোগানের ভাষা
বিদ্যালয় শেখায় শব ব্যবচ্ছেদ
মানুষেরা চোখে দেখে না
রঙিন চশমা ছাড়া
তুচ্ছ আজ সভ্যতা রক্ষায় প্রজনন।
এ সময় আমাকে কেউ কবিতা লিখতে বলো না
আমি তো ভুলে গেছি গীতিকবিতায় সন্বোধন
আমি তো ভুলে গেছি বনে বনে পাখির শিস
ঝর্ণা জলের বাঙময়
ভালবাসার মতো ত্রিপল্লীর মাধবীকে
আজ আর মনে পড়ে না একদম মনে পড়ে না।
এ সময় কবিতা হবে একেবারে গদ্যময়
শব্দ হবে গ্রেনেড ফাটার মতো সুন্দর
এ সময়ের তাই শ্রেষ্ঠ কবি হিটলার।
শিবলী মোকতাদির
কাকতাড়ুয়া
বিনয় ও বেদনার মাঝে,
কিছুটা বাইজী ও বাতাসার লোভে
ফের তোমাকে আন্দোলনে নিযুক্ত হতে বলি।
বলি, নিকটে আমার উত্তরে ভেসে আসো...
যদিও উপকূল পশ্চিমে তোমার
নানান কৌশলে আজ অস্পষ্ট করে তোলো।
যেহেতু তুমি প্রশ্ন আর প্রতাপে বিভাগীয়,
তরঙ্গ-তর্কে শুধু বাঘের জঙ্গলে যেতে বলো।
ফলে আমি বিচিত্র বর্ষায় ভিজে ভিজে ‘শিকারীর’ প্রতিটি
অক্ষর মুছে ফেলে- আজ একেবারে শান্ত, হলুদ সর্ষে বনে
একা ভদ্রাসনে দাঁড়িয়ে আছি-
ভয় ও ভাঁজের ব্যাকরণে।
দূরে নানান জনতা, গৃহস্থের নানান অলিগলি
অকুস্থলের আশেপাশে কিছু মেঘাচ্ছন্ন কিশোর-কিশোরী
আর যত জ্ঞানী ও গম্ভীর পাখ-পাখালি।
শুধু দিবসের অনুরোধে রাত্রির ঘটনা ঘটে
দেখি এক নাদান গ্রাম্য-টহল-পুলিশ
ঢোলকলমির ঝোঁপে ভয়ে, নিজেকে আড়াল করে
মাটির রাইফেলে গুলী ফোটাতে ফোটাতে
নিবিড় সন্দেহে ভাবে-
ব্যাটা কি কাকতাড়ুয়া নাকি?
অতনু তিয়াস
বৌ
কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
সারাবেলা বৌ বৌ খেলে ভেসে যায় সোনার সংসার
বৌ আমার কুয়াতলায় মাটির কলসি ভাঙে রোজ
চালুনি-কুলার কাজে ভুল করে কাঁদে
হাঁড়ির ভেতর পুড়ে চাড়া হয় লাউফুলভাত।
কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
বৌ আমার বাউটির শাদা রঙ সিঁদুরের লাল দেখে হাসে
সাঁঝের তুলসী তলায় হাসে না কেবল মাটির পিদিম।
লাঙলের ফলায় এখনো লেপ্টে আছে গাভিন জমির দো-আঁশ শরীর
মাটি থেকে তুলে আনা সোনার মোহর কাঁদে অযতœ লালনে
যে বোঝে না ফসলের সোনালি কীর্তন
আঁচলের গিঁট খুলে তার হাতে তুলে দিচ্ছ ভাঁড়ারের চাবি...
তোমার শীর্ণ হাতের স্নেহজ পূজার লোভে
শূন্য হতো এ বাড়ির ও বাড়ির লক্ষ্মীর আসন
আজ এই ঘর ছেড়ে অনাহারী দেবতার হাত ধরে সুখ চলে যায়।
আমার পুতুল বৌ কোনোদিন বিষ্ণুপ্রিয়া হলে
হাতের রেখায় তার ফুটে উঠবে প্রসন্ন ধানছড়া।
খালেদ রাহী এর কবিতা
কেবলি হেরে যাই
আমি কেবল হেরে যাই; কেবলি হেরে যাই
সকালে দেখা প্রেমিকের মুখে বিকেলে
শয়তানের মুখোশ।
হেরে যাই; কেবলি হেরে যাই
আহত বাঘিনীর জন্য বাঘের বিষন্ন মুখ
অথচ আহত সঙ্গিনীকে খামচে ধরে প্রেমিক পুরুষ ।
হেরে যাই;কেবলি হেরে যাই
মানুষ আর বাঘ কে বেশি হিংস্র?
ভাবতে ভাবতে দুঃসময় ভাঙি
আর বাঘকে ভালোবাসি।
মানুষকে না
মানুষকে না
সত্যি বলছি মানুষ কে না ।
মুখস্থ না হওয়া রাত
রুমা পণ্ডিত
কিছুটা রাত মুখস্ত করবো বলে
অন্ধকার মেখেছি আজ,
যে মাঠে দিনের আলোয়
বাল্য আর কৈশোর ধুলো মাখে
আর অন্ধকার নামলেই
হোঁচট খায় যৌবন
সেই মাঠে বসে জোনাকি ওড়াচ্ছি।
কয়েক হাত দুরেই
তিনটি উঠতি জীবন
নিজেদের ঘিরে রেখেছে
ধোঁয়ার বৃত্তে,
কিছুটা মরিচীকা দুহাতে ম
ভাঁজ করে রেখে
কাল,আজ আর কাল নিয়ে
জাগলিং খেলছে ওরা,
তৃষ্ণার্ত স্বপ্নগুলো
বৃত্তের বাইরে
অপেক্ষায়
কখন গড়িয়ে পড়বে দু ফোঁটা,
রাতের আস্ত শরীরে
মাঝ বরাবর মার্জিন কেটে
ওরা চলে যায়।
স্নায়ু ছেঁড়া যন্ত্রণার তীব্র আর্তনাদে
ঘুরে তাকালাম
তাপ্পি মাড়া গৃহস্থ চাদর ছেড়ে
বেরিয়ে এসেছে কিছু বন্য ভালোবাসা,
কোন যোগবিয়োগেই
যাদের হিসেব মেলেনি,
মেলে না,
প্রতি রাতেই ওরা
কিছু আঁচড় রেখে যায় এই ধুলোয়,
ওষুধের বেইমানিকে মেনে নিয়ে
কয়েক জোড়া নিরুপায় চোখ
কাচের ভেতর দিয়ে
শহর মাপছে,
মার্জিন এখন মধ্যিখান থেকে
অনেক দূরে
আমার কিন্তু এক লাইনও মুখস্থ হয়নি।
অনু ইসলাম
কুয়াশাব্যঞ্জনা
ক্রমাগত কুয়াশাবরফের শীতল আস্তরণ খসে খসে পড়ছে গাঙের মাঝে-
আলু ক্ষেতে, সরিষা ক্ষেতে, খেসারি-কলাই আর দুর্বাঘাসের সবুজ সমারোহে
তারই মধ্যে ফুটে আছে নানা রঙের ছোট্ট ছোট্ট ফুল, বসে আছে দূরন্ত ঘাসফড়িং
ছোট্ট খালের মতো চিকন একটা নদী দেখতে দেখতে ইতিহাস হলো ধলেশ^রী নামে।
স্বাপ্নিক অনুভূতিগুলো ফেলে আসা দূরবর্তী দৃশ্যসম্ভার দেখে ফ্ল্যাসব্যাকে
ঝুম-ঝুম শব্দের জন্যে আমরাও গেয়ে ওঠেছিলাম প্রার্থনার বৃষ্টিসঙ্গীত
আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, আল্লাহ মেঘ দে... রে...
এখন শীতের নির্জন দুপুরের মতো রুগ্ন লাগছে রাষ্ট্রীয় পরিবেশ;
রুগ্ন হয়ে গেছো তুমিও প্রিয়তম শহর
এই কুয়াশাব্যঞ্জনা নিয়ে অদৃশ্য অবহেলা কেনো এঁকে যাচ্ছো যাপিত জীবনে।
মরে যেতে ইচ্ছে করে
আমীর চারু
এক একটা দিন আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে !
তুমুল বৃষ্টির রাতে দ্বিধা গুলো সংজ্ঞাহীন সুতায় গেঁথে
আমার খুব চলে যেতে ইচ্ছে করে ।
আমার খুব ইচ্ছে করে
দীর্ঘশ্বাস গুলোকে নৈঃশব্দের ট্রেনে তুলে দিয়ে,
বেদনা গুলো কে কালরাত্রিগামী নৈরাজ্যের ভেতরে ছুড়ে দিয়ে ,
কষ্ট গুলো কে ইতিহাসের নাভিরন্ধ্রে বন্ধক রেখে,
শোক গুলো কে সর্বস্বতার কফিনে পুরে দিয়ে,
সত্যি, আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে ।
স্বরচিত সময়ে সাপিনীর বিষ দাঁত দেখে দেখে আমি বড় ক্লান্ত,
মৃতপ্রাণ কালাকালের উদয়াস্ত ছলাকলা দেখে দেখে আমি আজ ম্রিয়মাণ ,
জেনে গেছি বোধিসত্ত্বে আর জন্মাবে না বিদ্রোহ
তাই আমার খুব বেঁচে না থাকতে ইচ্ছে করে ।
সামতান রহমান
ক্রম
জানালা মাথায় নিয়ে ঘুরি
ফুলবৃক্ষ পেলেই পাশে রেখে দেখি,
গ্রিল ধরে উঠে আসে লতানো বোমা
তখন ঘুমিয়ে পড়েছি -
পড়তে পড়তে,
বুকের উপর উত্তর আধুনিক ব্যাকরণ।
দরজা মাথায় নিয়ে ঘুরি
সামনে রেখে ঢুকেই যাই যেকোনো আওয়াজে,
কারখানায়!