শেখর রায় : সচেতন ও প্রগতি চিত্তের মানুষের কাছে এক বড় প্রশ্ন যে কোন কাজটি এ মুহূর্তে আশু প্রয়োজন। ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সদ্ভাব গড়ে তোলা অথবা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করা।

যদিও এই দুটি দিকই একে অপরের পরিপূরক তথাপি জীবন ধারনের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সফলতা নির্ভর করে প্রথম সমস্যার অর্থপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা যা তখনি ফল লাভ করে যখন আপামর জনগণ একটি সংগঠিত বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের উপর আস্থা অর্জন করে।

ধর্মীয় মৌলবাদীরা প্রচার করে যে সাম্যবাদী মার্ক্সবাদীরা নাস্তিকতাবাদের প্রচার করে যা সর্বাংশে ভ্রান্ত ধারনা। এই ধারনা পোষণ করতে উৎসাহ জুগিয়ে চলে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সুবিধা পাওয়া মানুষজন। বিপরীতে একমাত্র মার্ক্সবাদীরাই সামাজিক ইতিহাসের মূল্যায়ন কোরে মনুষ্য সমাজে ধর্মীয় সুউপাদানগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করে। একই সাথে ধর্মের ঈশ্বরীয় ইচ্ছায় সৃষ্ট জমিদারতন্ত্র ও পুঁজিবাদী শোষণকে নির্দ্বিধায় সমালোচনা করে এবং সেই শোষণের কবল থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করতে সংগ্রাম কোরে দেশের শাসন ক্ষমতা বদল করে। যে কারনে মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে শাসক শ্রেণী নির্দ্বিধায় ইশ্বরবাদী ধর্মকে ব্যবহার করে।

এই বিপরীত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিরক্ষা ও সামন্তি শোষণ কায়েম রাখতে আশাহত নির্যাতিত কৃষক শ্রমিক বেকার মানুষের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে নব নব রূপে নিজেদের পেশ করে চলেছে এবং সমস্যায় জর্জরিত মানুষের কাছে নিজেদের আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। মিথ্যা প্রচার করে চলেছে যে বামপন্থী ও কম্যুনিস্টরা নাকি নিরীশ্বরবাদী। যদিও তাদের রাজনৈতিক দলীয় আদর্শ বা কর্মসূচীতে নেই নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিকতা। কারন মার্ক্সবাদীরা মনে করে যে নাস্তিকতা বাদ হলপুঁজিবাদের কোলে লালিত এক বুর্জোয়া ফ্যাসন, যে নাস্তিক কিংবা সমকামী তথাকথিত আধুনিক মানুষদের কাছে সর্বহারা জনগণের গণসংগ্রাম সংগঠিত করার কোন দায় নেই।

তথাপি কোনভাবেই এই ধর্মীয় মৌলবাদের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। কারণ মানব সমাজে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, গুম্ফা, তন্ত্র, মন্ত্র, ধর্মীয় জলসা, ধর্মশিক্ষা ও ওয়াজের প্রাধান্য যদি বজায় রাখতে দেয়া হয়, আপামর জনগণের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের অধিকারের সাধারণ সংগ্রাম এক পাও এগোতে পারে না। আর মানুষই যদি শেষমেশ বেঁচেই না থাকে সে কোন ধর্মগুরুর আদেশ মানবে বা কোন আল্লা গড ইশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করবে?

প্রগতিবাদী, সাম্যবাদী, মার্ক্সবাদী দল গুরুত্ব দিয়ে আগে অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে গণসংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়। দেশের অর্থনৈতিক শোষণ, অসাম্য ও রাজনৈতিক দমন পীড়ন খতম করে বঞ্চিত অবহেলিত নিপীড়িত সর্বধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। বিরোধিতা করে সেই রাষ্ট্রশক্তির যারা কোন বিশেষ ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রধর্ম কোরে ভিনধর্মের মানুষদের অত্যাচারে পরোক্ষ মদত দেয়। জনগণের মুল শত্রু অবশ্যই জনবিরোধী রাষ্ট্রশক্তি। রাষ্ট্রকে যে অবকাঠামো ও পরিকাঠামো দিয়ে টিকিয়ে রাখে সেই কাঠামোগুলিকে যদি না ভেঙ্গে দেয়া যায় বা দুর্বল করা যায়, তাহলে তার সৃষ্ট বা তল্পিবাহক কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলকে শুধু আক্রমণ করলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হয় না। কারন ধর্মীয় মৌলবাদ হল জনবিরোধী রাষ্ট্রের সেবাদাস।

ধর্মীয় মৌলবাদ তার মায়াজাদু দিয়ে মানুষকে মোহগ্রস্ত বা মাতাল কোরে তোলে। মানুষকে বিপথে চালিত কোরে দমনকারী রাষ্ট্রকে সচল রাখে, যে রাষ্ট্রশক্তি পুজিবাদের পাহারাদার। ইদানীং কালের ইশ্বরবাদি মৌলবাদ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সব সুফল গ্রহন কোরে অভাবী মানুষকে মোহজালে আবিষ্ট করে। এই মৌলবাদ মানব সমাজকে একজোট হয়ে রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায় না। এরা উগ্র ধর্মান্ধ যারা আজ সশস্ত্র, কারন শুধু মুখে ঈশ্বরের বানী প্রচার করে এখন কোন কাজ হয় না, তাই চাই নির্বিচার হত্যা, যে হত্যার লিস্ট থেকে বাদ যায় না স্বধর্মের মানুষও কারণ সেই ধরনের মানুষ এই দেবদূতদের শয়তানী ইচ্ছা পূরণে বাঁধা স্বরুপ, তাই তাকে হত্যা করাই শ্রেয়। এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের দেয়া হয় বিধর্মীকে ও বিপ্লবী কম্যুনিস্ট কর্মীদের ঘৃণা ও হত্যা করার শিক্ষা সংস্কৃতি। যার ফলস্বরূপ উদীচী নাট্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা হয়।

এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা প্রগতিশীল সংস্কৃতি লেখক, কবি, নাট্যকার, অভিনেতা ইত্যাদিকে চোখের মনির মত রক্ষা করা কম্যুনিস্টদের গুরুকর্তব্য পালনে দিশা নির্দেশ করে। সমাজ বদলের গণসাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে ধর্মীয় মৌলবাদ এক মারাত্মক বাঁধা স্বরূপ যাকে সমূলে ধ্বংস না করলে সামাজিক রাজনৈতিক প্রগতি আন্দোলন এক চুলও এগোবে না। তাই আমাদের সংস্কৃতি কর্মীদের লাগাতার সাংস্কৃতিক প্রচার বিপ্লবী রাজনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করবে। এই কাজ অহিংসাপন্থীদের দ্বারা একবারেই অসম্ভব। চোখের বদলে চোখ আর লাঠির বদলে লাঠি পৌঁছে দিতে পারে আমাদের সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে।

লেখক : ওপার বাংলার লেখক ও গবেষক