তাড়াশে ঐতিহ্যবাহী দই মেলা অনুষ্ঠিত
তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : শনিবার তাড়াশ হেলিপ্যাড মাঠে ষোল’শ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী দই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দই মেলা তাড়াশের ইতিহাস ঐতিহ্য আর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রথা এখনও তাড়াশ বাসিকে মনে করিয়ে দেয়।
প্রতি বছরের মত এবার তাড়াশে শ্রী-পঞ্চমীর অর্থাৎ স্বরসতী পূজা উপলক্ষে দই এর পসরা নিয়ে বসছে দই মেলাতে। দই মেলা আসলে চলনবিলের ঐতিহ্য বহন করলেও মূলত হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মিলন মেলার পরিনত হয়। দই মেলায় স্থানীয়, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে প্রায় শতাধিক ঘোষ সম্প্রদায়ের মানুষ মেলায় দই বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন। দই মেলা উপলক্ষে গত ৩দিন ধরে তাড়াশসহ আশেপাশের হাট বাজার গুলিতে দুধের দাম বৃদ্ধি পায়।
দই মেলার সূত্রপাত : তাড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালীর আমল থেকে অতিথি আপায়নে দই মেলার সূত্রপাত ঘটে। সেই থেকে প্রায় ৪শ’ বছরের ঐতিহ্য দই মেলা এখনও তাড়াশে বিদ্যমান। তৎকালিন জমিদার আমলে দই মেলার ব্যাপক জাকজমক ছিল। এ মেলায় জমিদার ও আমলারা বোর্ড বসিয়ে মেলায় অংশ গ্রহনকারী ঘোষদের গুণাগুণ যাচাই করত এবং শ্রেষ্ঠ দইয়ের পুরস্কার প্রদান করত। এবারও তাড়াশের দই মেলায় বগুড়ার শেরপুর, সিংড়ার, ডাহিয়া, চাটমোহরের অষ্টমিন্সা, শাহজাদপুর, বেড়া, ফরিদপুরের ডেমড়া, উল্লাপাড়ার ঘোষগাঁতী, বেলকুচি, রায়গঞ্জের ধানগড়া, ঘুরকা, গুরুদাসপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমান ও হিন্দু ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন দই নিয়ে আসছেন। পাকিস্থান আমলে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলে অধিকাংশ জমিদার পরিবারের অনেকেই ভারতে পারি জমায়। সেই সময় আমলা ও কর্মচারীরা ছেড়ে যায় তাড়াশ গ্রাম। এক সময় তাড়াশে গোসাই পরিবার ও অভিজাত হিন্দু নেতৃবৃন্দ মেলার তদারকি করলেও পুরস্কার প্রথা ধরে রাখতে পারেনি। আগে দইয়ের একচেটিয়া ক্রেতা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্তু জমিদার প্রথা বিলুপ্তর পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে বর্তমানে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন বেশী দই ক্রয় করছেন।
গোসাই পরিবারের মধ্যে নিতীশ চন্দ্র গোস্বামী ও অতুল গোবিন্দ গোস্বামী ৭০দশকে ভারতে চলে যাবার পর হিন্দু মুসলমান মিলিত ভাবেই মেলার তত্বাবধান করছেন। তবে বর্তমানে দইয়ের অধিকাংশ ক্রেতাই মুসলমান। মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ই দই মেলাকে টিকিয়ে রেখেছে। এবার তাড়াশের দই মেলায় মুসলমান ঘোষদের মধ্যে তাড়াশের করিম মিয়ার দই, ফজর আলীর দই, শ্রীপুরের চান মিয়ার দই, কাছিকাটার দই, বগুড়ার শেরপুরের দই, সিরাজগঞ্জের সয়াদাবাদের দই, রায়গঞ্জের চান্দাইকোনার দই, ঘুরকা বেলতলার দই,সিরাজগঞ্জ রোডের জবা দইসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ঘোষেরা দই বিক্রয়ের জন্য তাড়াশ হেলিপ্যাড মাঠে সকাল থেকে দইয়ের পরসা বসিয়েছেন।
ভাল দই মুর্হুতের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। প্রতিটি কাসা, খুটি ও নাড়ি প্রকার ভেদে ১২০টাকা থেকে ১৫০টাকা, আবার কোন দই ২৫০টাকা বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দই বেশী আমদানী হয়েছে। দই বিক্রেতারা কেউ কেউ ৩মন থেকে শুরু করে ১৫মন আবার কেউ ২০মন পর্যন্ত দই নিয়ে এসেছে।
দই বিক্রেতারা জানান, এ বছর দুধের দাম বেশী হওয়ায় অনেকেই ঝুকি নিয়ে দুরদুরান্ত থেকে দুধ সংগ্রহ করতে হয়েছে। দই মেলার জন্য সব খানের দুধের দাম অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশী হয়েছে গত ক’দিন ধরে। তাড়াশ সদরের দই ক্রেতা আব্দুর রশিদ, বোরহান উদ্দিন, দুলাল চন্দ্র, প্রশান্ত ঘোষ, ইয়াকুব আলী, সাধন সাহা, আইয়ুব আলী, আব্দুল বারিক জানান, বাজারে গত বছরের চেয়ে এবার বেশী হলেও দইয়ের মান তেমন ভাল নয়। নাম করা শ্রীপুরের দই গত বছর খুব খারাপ ছিল।
দই ক্রেতা ইয়াকুব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন এবার শ্রীপুরের দই ক্রয় করা থেকে বিরত থাকব। অনেক ক্রেতাই দইয়ের গুনগত মান যাচাই করার জন্য ৪-৫জনের নিকট থেকে দই ক্রয় করেছেন। মেলায় দই ছাড়া চিড়া, মুড়ি, মরকী, ঝুড়িসহ অন্যান্য সামগ্রী রয়েছে। তবে বেশী মানুষ দই চিড়া, মুড়ি ও মুরকী বেশী ক্রয় করতে দেখা গেছে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দই বিক্রি হবে বলে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন জানিয়েছে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫শ মন থেকে ৭শ মন দই বিক্রি হয়েছে বলে দোকানীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়।
(এমএইচএম/এএস/ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬)