মোঃ আশিকুল ইসলাম চয়ন : একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তার স্বাধীনতা।এক সাগর রক্ত আর অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। আমাদের এই অর্জনের পেছনে আছে হাজারো ভিনদেশি বিদেশী বন্ধুদের অকৃতিম সাহায্য সহযোগিতা। তাদের প্রতি আমরা সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞ।

তাদের এই ঋণ শোধ করার কোন দৃশ্যমান চেষ্টা কোন সরকার ইতিপূর্বে করে নাই। যখন আওয়ামীলীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশী বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সন্মাননা প্রদানের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, তখন একজন স্বাধীনতার স্বপক্ষের তরুণ হিসেবে আনন্দের সীমা ছিল না। এবং মনে মনে ভেবে ছিলাম এমন সিধান্ত নেওয়া জাতির জনকের কন্যার পক্ষেই সম্ভব।

একে একে অনেক বিদেশী বন্ধুদের এই সন্মাননা প্রদান করা হল, সবাই আসলেন গ্রহণও করলেন। পৃথিবী এক বিরল ঘটনা দেখল, যে জাতি স্বাধীনতার ৪২ বছর পর রাজাকারের বিচার করতে পারে, সেই জাতি ৪২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদেরকেও সন্মাননাও প্রদান করতে পারে।

কিন্তু যেই দিন গোটা জাতি জানতে পারলো যে, সন্মাননা ক্রেস্টের পনেরো আনাই মিছে অর্থাৎ স্বর্ণের পরিবর্তে পনেরো আনাই খাঁদ তখন নিজের প্রতি ভীষণ লজ্জা,ক্ষোভ আর ঘৃণা জন্মাল। ভুলে গেলাম কিছু সময়ের জন্য আমার পূর্বের সোনালী ইতিহাস।

এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের নাম যখন একে একে পত্র পত্রিকাই বেরুতে লাগলো, তখন ভাবলাম এবার আর তাদের রেহাই মিলবে না। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই হোল না।

আমি আরও বিস্মিত হলাম যখন (৩১/০৫/২০২৪ইং) গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বললেন ''স্বর্ণকারেরা মায়ের গহনা থেকেও স্বর্ণ চুরি করে'' তার মানে সন্মাননা ক্রেস্টের স্বর্ণও স্বর্ণকারেরা চুরি করেছে। প্রতিমন্ত্রী ও তার আত্মীয় সজনেরা একে বারে ধোয়া তুলশি পাতা।

এ দেশে দুর্নীতির শাস্তি হবে না, তা জনগণ একপ্রকার মেনেই নিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ পর্যায়ের ব্যাক্তির দুর্নীতির ব্যাপারে সাফাই গাওয়া ও অভিযোগ কারীর উপর আরোপিত দোষ নিয়ে নন্দ ঘোষের উপর চাপিয়ে দেওয়া সত্যি শুধু দুঃখজনকই নই চরম অসহ্যও বটে।

আমাদের দেশে নন্দর উপর দোষ চাপানোর সংস্কৃতি খুব প্রচলিত। বিরোধীরা সরকারের উপর আর সরকার বিরোধীদের উপর। এই ভাবে নিত্য চলছে আর চলছে।

আমরা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যাপারে দেখলাম ঐ একি চিরচেনা দোষারোপের সংস্কৃতি। আর এই ফাঁকে আসল খুনি চলে গেলো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই একি ভাবে আমাদের সফলতার সকল সম্ভাবনাও হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, যা কখনোই আমাদের দেশের বিকাশের সহায়ক হতে পারে না।

আমরা আজ কোথাই যাচ্ছি? আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার ভাবে লেখা আছে '' ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ''। তাহলে কোথাই আমাদের ঐক্য আর সংহতি।

কীভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ সফলতা অর্জন করবো? যে কোন জাতীয় বিষয়ে কি আমরা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবো না? প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে , বিকাশের এই মাহেন্দ্র ক্ষণে, স্বপ্ন ছোঁয়ার মুহূর্তেই নতুন প্রজন্ম কে আমরা উদ্বোধও করছি দুর্নীতির পথ অনুসরণ করতে। একবারও ভেবে দেখছিনা এই প্রজন্ম যদি দুর্নীতির সাথে সাবলীল হয়ে যায়, তাহলে আমাদের আশু ভবিষ্যতের কি হবে?

আমি মহাজোট সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভীষণ প্রশংসা করতাম, এই সরকারই প্রথম সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনা পয়সাই বই তুলে দিয়ে প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারি বই দিবস উদযাপন করছে। যা ইতিপূর্বে অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কিন্তু এই প্রশ্ন পত্র ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী শুধু সাফাই গাইছেন আর একটু আদটু স্বীকার করলেও দোষ চাপিয়ে দিছেন নন্দ ঘোষের উপর। বিশ্বজিৎ হত্যা হবে, রানা প্লাজা ধোসে যাবে, ফেনীতে হত্যা হবে , রামুতে মন্দির ভাঙ্গবে, শেয়ার বাজার লুণ্ঠন হবে, যাই হোক না কেন তদন্ত হোক আর নাই হোক উভয়ই দল বা দলের নেত্রীরা একে অপরজন কে নন্দ বানিয়ে দোষ চাপিয়ে দিবেন। আর এই সুযোগে সত্য মিলে যাবে অমানিশার অন্ধকারে। বিরোধীদের মতে এদেশে কোনদিন সরকার ভালো কাজ করে না, আর সরকারের মতে বিরোধীরা উন্নয়ন করার প্রশ্নই আসে না। এই ভাবে কাদা ছোড়া ছড়ী কতদিন চলবে?

দিনের পর দিন এই অপসংস্কৃতির চর্চা বেড়েই চলছে। তারেক রহমান এই অপসংস্কৃতির চর্চাই নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের প্রতি অপ্রীতিকর বক্তব্য প্রকাশের মধ্যমে। যা সত্যি লজ্জা দায়ক। তারেক রহমান হইত চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধুর সন্মানকে খাটো করতে, কিন্তু যে মহান মানব তার স্বীয় কৃত্তির দরুন হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাসে অক্ষয়ই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তার সন্মান ও মর্যাদা কে খাটো করতে গিয়ে তারেক রহমান তার নিজের সন্মান কি বাড়াতে পারবেন? বোধ হই উত্তর না।

রাজনীতিতে মতের অমিল থাকতে পারে কিন্তু পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শত মতের সংঘাতে শত পুষ্পের জন্ম ঘোটতেই পারে। আমাদের নিজেদের দোষ স্বীকারের সাহস থাকতে হবে, সবসময়ই নন্দ ঘোষের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে বা নিজেদের কে সাধু বানানোর প্রবণতা বর্জন করতে হবে। দিন বদলাবেই ,সময় তার জবাব নিতেই পারে, তাই আসুন আমরা আমাদের কে বদলাই তাহলে হইত দেশ বদলে যাবে।

লেখকঃ নিবন্ধক ও আহব্বায়ক, দ্যা ফোরাম অব নিউ ভোটরস।
[email protected]