রিপন আকন্দ(গাইবান্ধা):রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ভোরবেলা আসমানের সূর্য্যের আলোর ঝিলিকে চকচক করে চরের দানাদানা বালুকণাগুলো। পাখির কিচিরমিচিরতে ঘুম ভাঙ্গে মানুষের। শুরু হয় দিনের কাজকর্ম। সাতসকালেই গৃহবধুরা ঘুম থেকে উঠে ঘর ধোওয়ামোছা, রান্নাবান্না আর পুরুষরা যায় ক্ষেতখামারে, কেউবা ঘাস কাটতে।

আর চরের দুধ ব্যবসায়ীরা ব্যাতিব্যস্ত দুগ্ধ সংগহ করতে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে গাভীর দুধ সংগ্রহের তোড়জোড়। দুধ সংগ্রহকারীরা চরাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি থেকে গাভীর দুধ কিনে বিশেষ ধরনের টিনের পাত্রে ভরে রাখচ্ছে। পরে সেই দুধভর্তি টিনের ভার নিয়ে ওরা দুপুরের পর পরেই ঘাটে ভেড়ানো নৌকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দুধের পাত্র বোঝাই হতেই নৌকাগুলো ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ দিয়ে ছুটতে থাকে উপজেলা সদরের দিকে। এ চিত্র গাইবান্ধার ফুলছড়ির চরাঞ্চলগুলোর। চরের উৎপাদিত আশি ভাগ দুধেই বিক্রি হয় বিরাঞ্চলের। চরের অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি দুধের সম্ভারটাও কম না।

ফুলছড়ি উপজেলা সদরের মূল-ভূখন্ড থেকে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীদ্বারা একেকবারে বিছিন্ন ফুলছড়ি, ফজলুপুর ও এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়ন। এ তিনটি ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বর্ষায় ইঞ্জিনচালিত শ্যালোনৌকা, আর শুকনো মৌসুমে মোটরসাইকেল অথবা পায়ে হেঁটে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘপথ যাতায়াত করতে হয়। গত শুক্রবার সরেজমিন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি গ্রামের শেষ প্রান্তে এক সময়ের দুধ বিক্রেতা গোলাপ হোসেনের বাড়ি। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে তিনি জানান, নদীভাঙনে আমি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরে এগ্রাম ওগ্রাম ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করে ফুলছড়ি বাজারে বিক্রি করি। সে সময় প্রতিদিন ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকার বেশি আয় হতো না। তা দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋন নিয়ে বছর দশেক আগে একটি বকনা বাছুর কেনেন তিনি। সেই বাছুরটিই আজ তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। গোয়ালে তাঁর এখন ছয়টি দেশীজাতের গাভি। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লিটার দুধ দোহাচ্ছেন গোলাপ হোসেন। এখন তাকে আর বাজারে দুধ বিক্রি করতে হয় না। বাড়ি থেকে পাইকাররা ৩০ টাকা লিটার দরে দুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে প্রায় ১৮ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এর মধ্যে আবার গরুর খাবার হিসেবে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। তবে গোলাপ হোসেনের সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে ডাকাত ও জলদূস্যর। তাই প্রতিনিয়ত গাভীগুলোকে রক্ষায় রাত জেগে গোয়ালঘর পাহারা দিতে হচ্ছে তাকে।

ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি থেকে মোটরসাইকেলে চরে ফুলছড়ি ইউনিয়নের খঞ্চাপাড়া গ্রামের যেতে সময় লাগলো প্রায় ৩৫ মিনিট। কিন্ত ৩৫ মিনিট মোটরসাইকেলের পিছনে বসা ব্যাক্তিকে ধুলুবালিতে চেনাই মশকিল। শরীরের ধুলুবালি রুমাল দিয়ে ঝেড়ে ফেলার পর বেড় হলো আসল চেহারা। ওই গ্রামের মহিষের দুধ বিক্রি করে আলতাফ হোসেনের স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনী শোনার জন্য এ চরে আসা। তিনি হাসি মুখেই জানালেন তার ভাগ্যপরিবর্তনের গল্প, আমি দুধ বিক্রি করি এত কিছু করপ্যার পারব, তা কনোদিন ভাবি নাই। এই যে মহিষগুল্যোর জন্নেই আইজ হামার এরমক অবস্থা। ব্রহ্মপুত্র নদীরভাঙনে নিঃস্ব আলতাফ হোসেনের বসতভিটা পর্যন্ত ছিল না। ভাঙনদুর্গত আরও অনেক মানুষের সঙ্গে তিনি ফুলছড়ি উপজেলার যমুনার চর খঞ্চাপাড়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয নেন। অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে ও বর্গাচাষি হিসাবে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। আলতাফ হোসেনের ১৫ বছর আগে অবস্থা ছিল এ রকম। আজ তাঁর ঘরবাড়ি, জমিজমা- সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম একজন সচ্ছল মানুষ। সব মিলিয়ে তাঁর সম্পদের দামও অন্তত ৭ লাখ টাকা। তার গোয়ালে আজ ৫টি মহিষ। মহিষেই তার ভাগ্য পাল্টিয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি। প্রতিদিন প্রায় ২৩৫ থেকে ৩০ লিটার মহিষের দুধ পান। অবশ্য এ দুধের দাম তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি। মহিষের দুধ দিয়ে নাকি দই ভালো হয়। এজন্য জেলা সদর থেকে এসে এ দুধ ৪০ থেকে ৫০ টাকা লিটার ধরে কিনে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। গোলাপ হোসেন ও আলতাফ হোসেনের মতো গরু ও মহিষ পালন করে দুধলায়াদের অবস্থা বদলের অনেক কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় ফুলছড়ির চরাঞ্চলে গিয়ে। যেমন ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি গ্রামের দুধ বিক্রেতা বাদশা মিয়া, আবু সাঈদ, কছিম উদ্দিন, ফুলছড়ি ইউনিয়নের খঞ্চাপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, হাসেম আলীসহ প্রায় ৪০ জন ব্যাক্তি দুধ বিক্রি করে তাদের জীবনে এনেছে পরিবর্তন। বন্যা আর নদীভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটানো চরবাসীর জীবনে অর্থনৈতকি দুর্দশা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। তবে গরু-মহিষ লালন-পালনের মধ্যে দিয়ে দৈন্যদশা ঘুচে সচ্ছলতা এসেছে তাদের জীবনে।

উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পিপুলিয়া, খঞ্চাপাড়া, বাঘবাড়ি, দেলুয়াবাড়ি, পূর্ব খোলাবাড়ি, ফজলুপুর ইউনিয়নের পশ্চিম খাটিয়ামারি, পূর্ব খাটিয়ামারি, নিশ্চিন্তপুর, কাউয়াবাঁধা, এরেন্ডাবাড়ির হরিচন্ডি, আলগারচর, জিগাবাড়ি, গজারিয়া ইউনিয়নের গলনা, জিয়াডাঙ্গা, ভাজনডাঙ্গা, ঝানঝাইর, কটকগাছা, উড়িয়া ইউনিয়নের কালাসোনা, রতনপুরসহ ফুলছড়ি উপজেলার ছোট-বড় সব চরেই এখন গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। চরগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটি চরের দুরত্ব প্রায় ৩ থেকে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত। এসব চরে বসবাসকারীর লোকসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পিপুলিয়া, খঞ্চাপাড়া, বাঘবাড়ি, দেলুয়াবাড়ি, পূর্বখোলাবাড়ি, পশ্চিম খাটিয়ামারি, পূর্ব খাটিয়ামারি, নিশ্চিন্তপুর, কাউয়াবাঁধা, হরিচন্ডি, আলগারচর, জিগাবাড়ি, গলনা, জিয়াডাঙ্গা, ভাজনডাঙ্গা গ্রামসহ প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে গরুর ছোট ছোট খামার। সাতসকালেই চলছে গাভীর দুধ দোহানের তোড়জোড়। ব্যাতিব্যস্ত দুধ ব্যবসায়ীরা। কাজের ফাঁকে খাটিয়ামারি গ্রামের দুধ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সকাল ও বিকেল মিলিয়ে প্রতিদিন চর থেকে ১৫ থেকে ২০ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। সেগুলো ফুলছড়ি এলাকার বিভিন্ন বাড়ি ও মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন। তিনি আরও জানান, তাঁর মতো চরের কমপক্ষে ৪০ জন ব্যবসায়ী চর থেকে দুধ সংগ্রহ করে হাট-বাজারসহ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সরবরাহ করেন। এছাড়াও জেলা শহর থেকে ছানা তৈরির কারখানার অনেক লোক এসেও দুধ নিয়ে যান। দৈনিক কমপক্ষে ৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে। একই এলাকার আরেক দুধ ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া জানান, প্রায় ১ মণ ওজনের দুধের ভার ঘারে নিয়ে শুকনো মৌসুমে দুই থেকে তিন কিলোমিটার বালুচর পায়ে হেঁটে ঘাটে আসতে হয়। এতে আমাদের খুব কষ্ট ভোগ করতে হয়। সরকারিভাবে চরাঞ্চলে যদি পাকারাস্তা ঘাট তৈরি করা হতো। তাহলে রিস্কা-ভ্যানে করে আমরা দুধের টিন আনা-নেয়া করতে পারতাম। তখন এত কষ্ট পোহাতে হতো না।

ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখঘাটে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, দুধ নিয়ে আসা একটি নৌকা থেকে আট থেকে দশটি দুধের পাইকার টিনভর্তি দুধ নিয়ে কিনারে নামছে। নৌকা মাঝি কমল মিয়া জানান, বালাসীঘাট, হাজিরহাট ও ফুলছড়িঘাটে দৈনিক ৪টি দুধের নৌকা আসে। দৈনিক অন্তত ৫ হাজার লিটার দুধ চর থেকে আসে বলে স্থানীয় পশুসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়। এছাড়া গাইবান্ধা জেলা সদরে চরের গাভির প্রচুর দুধ যাচ্ছে ছানা তৈরির কারখানায় ও মিষ্টির দোকানে।

ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে টেংরাকান্দি চরে অবস্থিত ফুলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ। ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এম এ সবুর সরকার জানান, অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি চরে আয়ের উৎস হচ্ছে গরু পালন। কিন্তু চোর ডাকাতের উৎপাতে গরু পালতেও ভয় পাচ্ছে চরের মানুষজন। তার মতে, মানুষের নিরাপত্তার জন্য চরের টেংরাকান্দিতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজন। ফাঁড়ি স্থাপন হলে চরের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। বর্তমানে গাভির দুধ ও গরু মোটাতাজা করা থেকে ভালো লাভ হতে দেখে গরু পালনে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন চরের প্রায় বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরুর খামার। অন্তত ৬০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে এ গরু পালন করে।

ফুলছড়ি ইউনিয়নের পূর্বগাবগাছি যুব উন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি হাসান আলী জানান, চরে বর্ষার মাস চারেক ছাড়া বাকি সময় পাওয়া যায় প্রচুর কাঁচা ঘাস। বিনা খরচেই চরবাসী এই ঘাস সংগ্রহ করেন। ফলে গরু পালনের বার্ষিক খরচ অন্য এলাকার চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমে আসে। উপরস্তম, কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়ার জন্য গাভিগুলো দুধও দেয় বেশি। শুধু ওই চার মাস খড়-ভুসির ওপর গরু পালনকারীদের নির্ভরশীল থাকতে হয়।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হাদিউজ্জামান বলেন, চরে গরু পালন লাভজনক। কারন এখানে গো-খাদ্য সব সময় পাওয়া যায়। রাখাল সারাদিন গরুগুলো চরের পতিত জমিতে ছেড়ে দেওয়ায় খাদ্যের অভাব নেই। তাই সেখানে গরু পালন দিন দিন বেড়ে চলছে।
ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, নদী ভাঙনকবলিত এলাকা বলে আমার উপজেলার বেশির ভাগ চরবাসী কয়েক বছর আগেও ছিল বেশ অভাবী। কিন্তু গরু পালনের মাধ্যমে তাদের কপাল খুলতে শুরু করেছে। তবে একটি ভয় তাদের মধ্যে রয়েই গেছে। সেটি হলো গরু চুরি ও ডাকাতি। তার পরও তাদের এভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প আমি অন্য এলাকার মানুষদের শোনাই।

ফুলছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ ওসি মুহাঃ আতিয়ার রহমান জানান, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বিচ্ছিন্ন দূর্গম চরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়না। তার পরেও ব্রহ্মপুত্র নদের কয়েকটি পয়েন্টে নিয়মিত পুলিশী টহল দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চরের বিভিন্ন এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে জনগণকে সচেতন করতে সভা-সমাবেশ করা হচ্ছে।
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদুর রহমান মোল্লা বলেন, চরাঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবেই বাদাম, ভুট্টা, চীনা, মাসকালাই এবং কোনো কোনো অংশে ধান-গমসহ সব ধরনের ফসল চাষ হয়। সেদিক থেকে চরে কৃষকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। পাশাপাশি ব্যাক্তি উদ্যোগে এবং কৃষকরা গরু পালন করে পুষ্টিকর দুধ উৎপাদন করছে। চরে খাদ্যের ব্যয় খুবই কম। তাদের এ কাজে সরকারিভাবে সহায়তা পেলে চরগুলো আরও হয়ে উঠবে সম্ভাবনার সংকেত।



(আরআই/এস/ফেব্রুয়ারি২০,২০১৬)