মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ফুলগাজীর নিহত চেয়ারম্যান একরামুল হকের সাথে একবারই দেখা হয়েছিল আমার। সপরিবারে বেড়াতে এসেছিলেন বেলজিয়ামে বছর দুয়েক আগে। ব্রাসেলসের স্বনামধন্য কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব শহিদুল হকের মালিকানাধিন সুপরিচিত ‘রয়েল কাশ্মীর’ অভিজাত রেস্তোঁরায় তাঁরই মেহমানদের জন্য ছিল বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন। কাকতালীয়ভাবে আমারও উপস্থিতি সেদিন একই খাবার টেবিলে। সেই মানুষটিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে যতবারই দেখছিলাম ততবারই মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ক্লিপগুলোর সাথে ‘ইমপ্যাক্ট’ হচ্ছিল আমার ব্রাসেলসের ঐ নৈশভোজের স্মৃতিগুলো।

না পাঠক, আবেগ শেয়ার করার জন্য আপনাদের মূল্যবান সময় নেবার অধিকার আমার নেই। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বিজিবি’র মহান বীর, শহীদ মিজানের আত্মার ক্রন্দন শুনতে পেয়েছি বলেই রক্ত ঝরছে আজ বিজয় কীবোর্ডে, উঠে এসেছে নিহত একরাম আর ফেনীর গডফাদার-গডমাদার প্রসঙ্গ। চাইলেই তারা দিবানিশি আকাশে ওড়ান হেলিকপ্টার, উড়িয়েছেনও সেদিন। লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশে গডফাদারদের রামরাজত্ব আর কতকাল ? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার আগেই পহেলা জুন নাইক্ষ্যাংছড়িতে দেখতে হলো নায়েক সুবেদার মিজানের ৪ দিনের পচা-গলা লাশের প্রতি ‘রাষ্ট্রীয় অসম্মান’! বুকফাটা আর্তনাদ আর কঠিন প্রতিবাদ মিলেমিশে একাকার যেন আজ।

মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি)’র হাতে ২৮ মে বুধবার নিহত হন বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য মিজানুর রহমান। পারষ্পরিক সন্দেহ আর কথিত ‘ভুল বোঝাবুঝি’তে দু’পক্ষের বারবার গুলী বিনিময়ের পরিণতিতে লাশ ফেরত আনতে ৭২ ঘন্টা পেরিয়ে যায়। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ততোক্ষণে পঁচন ধরে ‘বাংলার বীর’ সেনার নিথর দেহে। ৩১ মে শনিবার বিকেলে মিয়ানমার বাহিনী হতভাগ্য মিজানের লাশ হস্তান্তর করে বিজিবি’র নিকট। সীমান্ত এলাকা থেকে লাশ এনে শনিবার রাতেই রাখা হয় নাইক্ষ্যাংছড়ির পাইনছড়ি ক্যাম্পে। দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পাইনছড়ি থেকে গলিত মরদেহ নিয়ে আসা হয় দুছড়ি খালে। ওঠানো হয় নৌকায়।

নিহত মিজানের পরনে তখনো বিজিবি’র পোষাক, যদিও ফুলে বিকৃত হয়ে যায় তার লাশ। খালের সামান্য পানিতে কিছুদূর নৌকা চালিয়ে আবার কিছুদূর ঠেলে ঠেলে লেমুছড়ি বিজিবি ক্যাম্প থেকে পানিপথে ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কালুরঘাট পৌঁছে সীমান্তসেনার মরদেহ। খুব বেশি ফুলে যাওয়ায় খাল পাড় থেকে গাড়িতে ওঠানো সম্ভব হচ্ছিল না লাশ। ভয়াবহ দুর্গন্ধ এড়াতে লাশের ওপর প্রতিনিয়ত ঢালা হচ্ছিল কেরোসিন। লেখার একপর্যায়ে মিজানকে ‘হতভাগা’ উল্লেখ করায় পাঠক, ক্ষমা চাইবো শহীদ মিজানের কাছেই। দেশের তরে জীবন দিতে পারায় মিজানই মূলতঃ সবচাইতে ‘ভাগ্যবান’।

চরম দুর্ভাগ্য আসলে আমাদের, হতভাগা বাংলাদেশ ! কপাল পোড়া জাতি আমরা। নইলে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভেতর চিহ্নিত গডফাদার-গডমাদার রুই-কাতলা রাঘব-বোয়ালদের কালো টাকায় নাপাক হওয়া হেলিকপ্টারগুলো না হোক, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীদের বহনকারী হেলিকপ্টারগুলোর অন্তঃত একটি ব্যবহার করে যদি শনিবারই শহীদ মিজানের গলে যাওয়া লাশের প্রতি প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া হতো, তবে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো ? রবিবারও দিন পেরিয়ে সারা রাত লাশ ফেলে রাখা হলো। সর্বশেষ খবর অনুযায়ি, ২ জুন সোমবার সকালে নাইক্ষ্যাংছড়িতে প্রথম জানাজা শেষে হেলিকপ্টারে করে শেষ মুহুর্তে শহীদ মিজানের মরদেহ কুমিল্লার চান্দিনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্মান যদি দিতেই হয় তবে তা যথাসময়ে যথাযথভাবে নয় কেন ? সময়মতো হেলিকপ্টার না পাঠিয়ে ‘রাষ্ট্রীয় অসম্মান’র পর ‘রাষ্ট্রীয় মর্যাদা’য় দাফন করলেই কি শহীদের আত্মা শান্তি পাবে ? মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাংলাদেশে গত ৪ দশকে কি কোন ‘ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা’কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নজির নেই ?

‘বিডিআর’ নাম পাল্টে আপনারা ‘বিজিবি’ করেছেন, কিন্তু এ্যাচিভমেন্ট কোথায় ? পিলখানা ট্র্যাজিডি আজো আমাদের কাঁদায়। ৫৭ জন সেনা অফিসারের রক্তের ঋণ কোনদিনই শোধ হবে না, কিন্তু ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ‘মাস্টারমাইন্ড’ যাঁরা, তাদেরকে কি আদৌ বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ? গুম হবার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সুষ্পষ্টভাবে বলতে চাই, নায়েক সুবেদার মিজানের লাশকে যেভাবে ‘রাষ্ট্রীয় অসম্মান’ করা হলো, তাতে আর যাই হোক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় সেই গডফাদারদের ‘হেলিকপ্টার গর্জন’। শহীদ সীমান্তসেনার আত্মার ক্রন্দন শুনতে কি পাও, হে বাংলার জনগণ ! তোমরা নাকি সকল ক্ষমতার উৎস!

(এএস/জুন ০২, ২০১৪)