গাইবান্ধা থেকে রিপন আকন্দ : স্বামীর দিনমজুরীর আয়ে সংসার চলে না। নারী হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকায় আমিও তাকে কোন কাজে সাহায্য করতে পারি নাই। অর্ধাহারে-অনাহারে কত যে রাত গত করেছি তার খোঁজ কেউ রাখেনি।

সংসার চলার মতো রোজগারের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেকার স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রিত হলাম। কাজের ব্যস্ততার মাঝে পূর্বের দু:খ গাঁথা দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই কেঁদে ফেলেন সাজেদা বেগম। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে তিনি আবারও বলতে লাগলেন, বিয়ের আগে বাবার বাড়ি, বিয়ের পরে স্বামীর বাড়ি। এমনিতেই তো নারীদের নির্দিষ্ট কোন বাড়ি নাই। তার উপর বিবাহিত নারীর স্বামী যদি বেকার হয়? অনেক কষ্ট করেছি, যার ফলে নিজেও বেকার স্বামীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। উপরোক্ত কথাগুলো বলেন জীবন যুদ্ধে অপরাজিত এক নারী সাজেদা বেগম।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের ডাকাতিয়ার চরে বাস করেন সাজেদা বেগম (৩৫)। তার স্বামীর নাম আবুল কালাম আজাদ। বেকার স্বামীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে গত ২০১০ সালে উত্তরাঞ্চল ভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গাইবান্ধার গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের লাইভলীহুড মাইক্রোফাইনান্স কর্মসূচীর আওতায় এরেন্ডাবাড়ি শাখার শাপলা মহিলা সমিতিতে সদস্য হন সাজেদা বেগম। সঞ্চয় বৃদ্ধির পাশাপাশি হাতে কলমে প্রশিক্ষণও গ্রহন করেন তিনি। পরে ওই সংস্থা থেকে সবজি চাষের উপর ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে প্রথম দফায় ১০ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে কপি ও টমেটো চাষ শুরু করেন।

স্বামী স্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত এবং যৌথ প্রচেষ্টায় মৌসুম ভিত্তিক আগাম সবজি চাষে আর্থিক ভাবে লাভবান হন সাজেদা বেগম। তিনি ক্রমান্বয়ে সবজি চাষের জমির পরিধি বাড়াতে থাকেন। মৌসুম ভিত্তিক জমি বন্দক (র্বগা) নিয়ে বর্তমানে তিনি ৮ একর জমিতে কপি ও টমেটো চাষ করে চরাঞ্চলে টমেটো চাষী হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। প্রতিদিন জমি থেকে ৫০ মণ টমেটো উৎপাদিত হচ্ছে। তার ক্ষেতের সবজি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে গাইবান্ধা শহরের কাঁচামালের আঁড়তসহ ঢাকায় বাজারজাত করছেন। তার ৮ একর জমিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষাধিক টাকার মতো। এ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন সাড়ে ৭ লক্ষাধিক টাকা। তার জমির টমেটো বিক্রি করে এখনও ৪ লক্ষাধিক টাকা পাওয়া যাবে বলে সাজেদা বেগম জানান। গত বছর টমেটো বিক্রি করে ৪ লক্ষাধিক লাভের টাকায় স্থায়ী ভাবে মাথাগোঁজার ঠাঁই হিসেবে ১৫ শতকজমি ক্রয় করে তাতে ৩০ হাত লম্বা চৌচালা টিনের ঘর র্নিমাণ করেন। এছাড়াও ১৫ শতক জমি র্বগা নিয়েছেন।

প্রতি মৌসুমে তার সবজি বাগানে উৎপাদিত হয় টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, শসা, করলা ও চিচিঙ্গা। ফসলের পরিচর্য্যা করার জন্য দৈনন্দিন ১২ থেকে ১৫ জন দিনমজুর তার জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যক দিনমজুরকে ৩শ’ টাকা করে দিতে হয়। সাজেদা বেগমের স্বামী আবুল কালাম আজাদ জানান, কৃষি বিষয়ে কোন ধারনা ছিল না। এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন বীজ ভান্ডারের পরার্মশ নিয়ে ২০ শতক জমি থেকে বর্তমানে ৮ একর জমিতে সবজি চাষ করছি। জমিতে বীজ বপন/রোপন, সার প্রয়োগ, পোকামাকর দমনে কীটনাশক প্রয়োগ, ভিটামিন দেয়া, সঠিক সময়ে নিড়ানি ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞ চাষীদের পরামর্শ নিতে বিলম্ব হওয়ায় অনেক বার বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছি।

তিনি দু:খ করে বলেন, এ পর্যন্ত সরকারী ভাবে কোন কৃষি কর্মকর্তার পরার্মশ পাই নাই। যদি পাওয়া যেত তবে ফসলসহ আমার আর্থিক ক্ষতি হতো না। চার দেয়ালের মাঝে বন্দি না থেকে অল্প পুঁজিতে ক্ষেতে খামারে কাজ করলে অবশ্যই আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। ছেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে ভবিষ্যতে তার ব্যবসার পরিধি বিস্তার করে তাতেই সুযোগ সৃষ্টি করবেন বলে সাজেদা বেগমের ভবিষ্যত পরিকল্পনা।

উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মন্ডল বলেন, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির পরির্পূণতা আসে না। কিন্তু ডাকাতিয়ার চরের সাজেদা বেগম (৩৫) ও তার স্বামী আবুল কালাম আজাদ কোন পড়ালেখা জানে না। নিজেরা পড়ালেখা না জানলেও র্মুখতার গ্লানি ঢাকতে ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন সাজেদা বেগম। বড় মেয়ে স্নাতক, ২য় ছেলে ১০শ্রেণী ও ৩য় ছেলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে।

এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাহাজুল ইসলাম জানান, লোকবল সংকটের কারণে দুর্গম চরাঞ্চলে সব সময় কৃষকদের সাথে যোগাযোগ ও পরামশর্ দেয়া সম্ভব হয় না। সাজেদা বেগম চরের জমিতে টমেটো উৎপাদন করে চরের কৃষকদের তাক লাগিয়েছেন।

ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা জানান, কৃষি ক্ষেত্রে সাজেদা বেগমের ভূমিকা আমাকেও মুগ্ধ করেছে। যা সবার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

(আরএ/এএস/০২ মার্চ, ২০১৬)