আরিফুন নেছা সুখী : সময় পাল্টেছে। দিন বদলেছে, কিন্তু নারীর ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি এতটুকু। এখনও নারীদের শ্রমবৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের নারীদের শ্রমবৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে বেশি।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবস হচ্ছে সেই দিন জাতিগত, গোষ্ঠীগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে নারীর অর্জনকে মর্যাদা দেওয়ার দিন। এদিনে নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে এবং ভবিষ্যতের পথ পরিক্রমা নির্ধারণ করে, যাতে আগামী দিনগুলো নারীর জন্য আরো গৌরবময় হয়ে ওঠে।

কথা হলো কয়েকজন নিম্নআয়ের নারীর সঙ্গে। নাজমা বেগম ফার্মগেট এলাকার একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাকে মাসে খাওয়া-দাওয়াসহ দুই হাজার টাকা দেয়া হয় বলে তিনি জানান। কিন্তু একই বাড়িতে কর্মরত দারোয়ান মনিরকে দেয়া হয় খাওয়া-দাওয়াসহ মাসে পাঁচ হাজার টাকা। অথচ নাজমা বেগম বাড়ির যাবতীয় কাজ করেন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাচ্চাকে স্কুলে, কোচিংয়ে আনা-নেয়া পর্যন্ত। আর মনির শুধু চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। আর মাঝে মাঝে একটু ফায়ফরমায়েস খাটে। এভাবেই বলছিলেন নাজমা বেগম।

আবার গ্রামাঞ্চলের দিকেও একই দৃশ্য। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার ফিলিপনগর গ্রামের ফুদুজান বেওয়া পানের বরজে মাটি তোলার কাজ করেন। সেখানে তিনি দুইশ’ টাকা দিনমজুরি পান, পুরুষ শ্রমিকরা পান তিনশ’ টাকা। আবার কোনো বাড়িতে কাজ করলে তাকে একশ’ টাকা দেয়া হয়, পুরুষ শ্রমিককে দেয়া হয় দুইশ’ টাকা।

মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বললে একজন মহিলা মালিক বলেন, পুরুষ মানুষ বেশি পরিশ্রম করে। একজন নারী একই সময়ে একজন পুরুষের চেয়ে তুলনামূলক কম কাজ করতে পারে। তাই তাকে কম পারিশ্রমিক দিই। কিন্তু ফুদুজান বলেন তার সঙ্গের পুরুষ শ্রমিকটি সারাদিনে যত ঝুড়ি মাটি টানে তিনিও একই পরিমাণ মাটি টানেন। আবার তিনি এও বলেন, বাড়ির কাজে পুরুষ শ্রমিক দুপুর পর্যন্ত কাজ করে আর আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেও মজুরি কম পাই।

দিনে দিনে ঘরে-বাইরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না তাদের পারিশ্রমিক। প্রয়োজনের তাগিদে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয় নারী কিন্তু সেই নারীকেই প্রতি পদে হতে হয় হেয়। আবার কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হওয়ার পাশাপাশি ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাকে।

পোশাক নির্মাণসহ অন্যান্য উত্পাদনশীল কারখানা ও বিল্ডিং তৈরির নানাবিধ কাজে নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে কিন্তু তাকে সমান পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজ করে মর্জিনা বেগম। তিনি ইট ভাঙা ও মাটি টানার কাজ করেন। কিন্তু তাকে পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কমপক্ষে পঞ্চাশ থেকে একশ’ টাকা কম মজুরি দেয়া হয়।

পোশাক নির্মাণ শিল্পে কর্মরত সাবিনা খাতুন। তিনি বলেন, এখানেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কম বেতনে কাজ করে। প্রতিবাদ করলে সরাসরি মালিক কর্তৃপক্ষ বলে, ‘মন গেলে থাকেন, না মন গেলে সোজা রাস্তা মাপেন।’ এভাবেই প্রতিদিন নানা অপমানজনক কথা সহ্য করে আমাদের কাজ করতে হয়।

পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানায় ত্রিশ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন, যার শতকরা হার মোট শ্রমিকের নব্বই ভাগ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শহরাঞ্চলে উত্পাদনমুখী কারখানা, পোশাক শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ, খাদ্য ও কোমল পানীয় তৈরির কারখানায় অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানায় নারী শ্রমিক নিয়োগের একমাত্র কারণ নারীরা এই কাজগুলোতে দক্ষ। আর তাছাড়া সস্তায় দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ সম্ভব বলেও নারী শ্রমিক বেশি নিয়োগ দেয়া হয়।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে পাঁচ থেকে সতের বছর বয়সী প্রায় বিশ লাখ গৃহশ্রমিক বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে, তার মধ্যে একষট্টিভাগ কোনো বেতন পায় না। এমনকি পঁয়তাল্লিশ ভাগ জানেই না বেতন কি জিনিস। (তথ্য সূত্র : দৈনিক সমকাল)

শুধু কি কর্মক্ষেত্রে? ব্যবসা ক্ষেত্রেও নারীকে অবমাননার শিকার হতে হয়। একজন মহিলা সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে কম দামে সবজি কিনতে চায়, আবার নারী বলে ন্যক্কারজনক কথা বলতেও ছাড়ে না অনেকে।

বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, গত প্রায় দুই দশক ধরে স্থানীয় ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে অধিক হারে। খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আট মিলিয়ন নারীর মধ্যে শতকরা চল্লিশজন গ্রামে বসবাস করে। এদের অধিকাংশই শ্রমজীবী নারী। দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মপরিবেশ ও বেতন দেয়া হচ্ছে না নারী শ্রমিকদের। পোশাক নির্মাণসহ অন্যান্য উত্পাদন কারখানায় মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বেশি।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় বিপজ্জনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরি এবং দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে নারীশ্রমিকরা প্রতিবাদ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৮ মার্চে উল্লেখযোগ্য আরো ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করে। তখন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপন করা হয়।

‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৬’-এর মূল প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’। তরুণরাই আগামী দিনের কর্ণধার। তাই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ নির্মাণে চাই তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা। এই বৈষম্যপূর্ণ সমাজ পরিবর্তন করে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করে নারীকে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিতে হবে। আর এই লড়াইটা শুরু হয়েছে আজ থেকে শতাধিক বছর আগে। কিন্তু আজ পর্যন্ত নারীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় তুমি নারী। তুমি পুরুষের চেয়ে কম কর্মক্ষম। কিন্তু সত্যি কি তাই? বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় নারীরা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শুধু একশ্রেণীর মানুষের হীনমন্যতার কারণেই নারীরা শ্রমবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

আর কোনো নারীকে শ্রমবৈষম্যের শিকার হতে হবে না, এই দাবিতে সোচ্চার হতে হবে সবাইকে। আমিকেন্দ্রিক ভাবনা না ভেবে সামগ্রিক ভাবনা নিজের মধ্যে তৈরি করতে হবে। আমি উচ্চমান কর্মকর্তা পুরুষের সমান বেতন পাচ্ছি। পাচ্ছি নানা সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু আমার গৃহকর্মীটিকে কি তার ন্যায্য পাওনাটা দিচ্ছি? এভাবেই ঘরে ঘরে পরিবর্তন এলে সমাজে পরিবর্তন আসতে খুব সময় লাগবে না।