চাটমোহর (পাবনা) থেকে শামীম হাসান মিলন : আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে গেলেও এখনও দেশে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ঘরে-বাইরে অবমুল্যায়িত হতে দেখা যায় প্রায়শই। জনপ্রতিনিধি হলেও তাদের ভূমিকা জোরালো হয়না।

সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মুজুরী বঞ্ছিত হওয়া নারী শ্রমিকের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। কিন্তু এসব কিছুর ব্যতিক্রম পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভূমিহীন নারীরা। পুরুষের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে তারা খাসজমিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন আন্দোলন করে পেয়েছেন সফলতা। সংসারে এনেছেন স্বচ্ছলতা। যাদের মধ্যে আছেন স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা নারীও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও ভূমিতে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছেন এখানকার ভূমিহীন নারীরা।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামের ভূমিহীন নারী আভা রানী। ২২ বছর আগে মাছ ধরে চালানো তার স্বামীর টানাটানির সংসারে জুটতো না দু’মুঠো ভাত, পড়নে ছিল ছেঁড়া কাপড়। এরপর বিলকুড়ালিয়ার খাসজমি নিয়ে পুরুষের সাথে আন্দোলনে শামিল হন তিনি। এক টুকরো খাসজমি সরকার থেকে একসনা লীজ নিয়ে নিজেই চাষাবাদ করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে মাস্টার্সে পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্য ছেলে অনার্সে।

আভা রানীর মতো স্বচ্ছলতার এমন চিত্র বিলপাড়ের ১৩শ’ ভূমিহীন নারীর সংসারে। দীর্ঘ ২৩ বছর নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে পুরুষের সাথে বিলকুড়ালিয়ার ১৪শ’ বিঘা খাসজমিতে নিজেদের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন নারীরা। সাথে রয়েছেন স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীও। নারী হয়েও ঘরে বন্দি না থেকে তারা কোমড়ে কাপড় পেঁচিয়ে নেমেছেন ফসলের মাঠে। পুরুষের সাথে ফসল বোনা থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত পরিশ্রম করেন এসব ভূমিহীন নারীরা। যাদের মুখে এখন শুধুই এগিয়ে চলার গল্প।

স্বামী পরিত্যক্তা আনোয়ারা খাতুন, বিধবা ফুলজান বেওয়া ও জরিনা খাতুন জানান, ২২ বছর আগে ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পারতাম না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারতাম না। সমাজের মানুষ কেমন যেন একটু অন্যরকম চোখে দেখতো। দাম দিতো না। এখন বিলকুড়ালিয়ার খাসজমি নিয়ে আন্দোলন করে জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত পেয়েছি। ঘরে সারাবছরের খাবার জন্য ধান থাকে। ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুল কলেজে পড়ে। সমাজের সবাই সম্মান করে, দাম দেয়।

ভূমিতে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সমাজে নানাভাবে মুল্যায়িত হচ্ছেন ভূমিহীন নারীরা। গ্রামের অসহায় নারী বলে কেউ তাদের অবহেলা করছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সংসারে রাখছেন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা। ভূমিহীন নেত্রী চাম্পা খাতুন ও ছানোয়ারা খাতুন বলেন, গ্রামের নারী বলে এখন আর আমরা পিছিয়ে নেই। ঘরে বসে থাকি না। পুরুষের সাথে কাজ করি, ফসল ফলিয়ে ঘরে তুলি। বিলকুড়ালিয়ার নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করছি। খাসজমিতের আমাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া, বড় সফলতা।

১৫টি গ্রামের ভূমিহীন নারী-পুরুষের সম অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছেন ভূমিহীন উন্নয়ন সংস্থা (এলডিও)’র নির্বাহী পরিচালক আতাউর রহমান রানা। তিনি বলেন, বিলকুড়ালিয়ার নারীরা পুরুষের সমান কাজ করেন, সমান ভূমিকা রাখেন। মিছিল, মিটিং, প্রশাসনের সাথে কথা বলা, মামলায় লড়াই করা সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে এখনাকার নারীরা। ২২ বছর তারা ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই করে টিকে আছেন। যা অনুসরনীয়। নারী-পুরুষের সম অধিকারে সরকারের যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নে সকলের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত: গত বছরের শেষের দিকে বিলকুড়ালিয়ার ১৪শ’ বিঘা খাসজমি বিলপাড়ের ১৩শ’ ভূমিহীন পরিবারের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে ৮শ’ পরিবার জমির দলিল বুঝে পেয়েছেন। এর মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা রয়েছেন ২১৮ জন।

(এসএইচএম/এএস/মার্চ ০৮, ২০১৬)