পীরগঞ্জ (রংপুর)প্রতিনিধি :গত ৭ মার্চ  পীরগঞ্জে ‘বৃক্ষমানব পরিবারের সন্ধান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর আক্রান্ত পরিবারটির ৩ সদস্যকে ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এসে পরীক্ষা করার পর ভর্তি করে নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও, অর্থোপেডিকস্ বিশেষজ্ঞসহ ডাক্তাররা তাদেরকে পরীক্ষা করে আপাততঃ ‘বৃক্ষমানব’ প্রকৃতির হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস’ সনাক্ত করেছে।

জানা গেছে, পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাপুর গ্রামে আফান মুন্সি এ রোগে তার হাত ও পা আক্রান্ত হয়। তার ঘরেই জন্ম নেয়া ২ পুত্র- বাছেত মিয়া ও তাজুল ইসলাম এবং কন্যা সাফিয়া খাতুন। তারা ৩ জনই এ বিরল রোগে হাত-পায়ে আক্রান্ত হলে সাফিয়া মাত্র ৯ বছর বয়সে ১০/১২ বছর আগে মারা যায়। এরপর তাদের বাবা আফান মুন্সিও মারা যান ৭৫ বছর বয়সে।

এদিকে বৃক্ষমানব রোগে আক্রান্ত তাজুলের ২ সন্তানের মধ্যে রুবেল মিয়াও জন্মের পর হাত ও পায়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়। দরিদ্র এ পরিবারের পক্ষে শুরু থেকেই শুধু ব্যাথানাশক ওষুধ সেবন করেই চিকিৎসা কাজ শেষ করেছেন। ততদিনে বাড়তে থাকে তাদের হাত-পায়ের নখ ও তালুর চামড়া-মাংস। একপর্যায়ে শক্ত হয়ে যায়। পরে শক্ত অংশ কাটতে গেলেই গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। ভিক্ষাবৃত্তি করেই তাদের সংসার চলে।

এরই মধ্যে রুবেল মিয়াকে রাধাকৃষ্ণপুর প্যালা ভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলে প্রধান শিক্ষক সেকেন্দার আলী তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়। পরে রুবেলকে চকফুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেনীতে ভর্তি করা হয়। এখনো তার পড়লেখা চলছে। এ ব্যাপারে রুবেল জানায়, মোক আগের স্কুল থাকি বার (বের) করে দেয়ার পর চকফুলাত গেছো। বাড়ীত থাকি ১ কিলোমিটার হয়। পায়ে হাঁটিই কষ্ট করি খোড়ে খোড়ে যাও। ককনো ভ্যানোত চড়ি যাও। সেও তার বাবার ভিক্ষার সাথী হয়ে গ্রামে চলাফেরা করে। রুবেলের ডান চোখের নীচে ও ভ্রুর উপরে এবং কপালের বেশকিছু অংশে গাছের পাতার মতো নীলিমা-কালচে রং ধরে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাছেত মিয়া জানায়, জন্মের পর থাকিই অসুখটা হছে। সারা রাত বিষে (ব্যাথায়) কান্দাকাটি করি কষ্টে রাত পার করো। চামচ দিয়া ভাত খাও। জেবোনে কখনো গোস্ত (মাংস) খাও নাই। হাত দি ধরবার না পারলে ক্যাংকরি খাও ? বিষের জ্বালায় দেড় বছর আগে মোর দুই পা’ রংপুর উত্তম সেবা ক্লিনিক থাকি কাটি নিয়া আসছো। এখন পায়ে বিষ নাই। হাতোত আছে। হাঁটু থেকে কাটা পায়ে ব্যাথা নাই বটে, তবে পায়ের ভিতরে কীট কীট করে কামড়ায় আর জ্বালা করে বলে সে জানায়। হায় আল্লাহ্ এমন রোগ, চেকেৎসা নাই বাবা বলেই হাসপাতালে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। এ সময় উপস্থিত অনেকেরই চোখ ভিজে যায়।

গতকাল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ জিয়াউর রহমান, অর্থোপেডিকস্ বিশেষজ্ঞ এনামুল বাশার, ডাঃ মুনিরা বেগম, উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে এ রোগের ব্যাপারে বাহ্যত পরীক্ষা করেন। এ সময় উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন, স্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বৃক্ষমানব রোগে আক্রান্ত বাছেত মিয়া (৫২), তাজুল ইসলাম (৪২), শিশু সন্তান রুবেল মিয়ার (১০) ব্লাড প্রেসারও পরীক্ষা করা হয়। পরে তাদেরকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে অর্থোপেডিকস্ বিশেষজ্ঞ এনামুল বাশার বলেন- আপততঃ বিরল রোগটিকে ‘বৃক্ষমানব’ প্রকৃতির হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস’ ভাবছি। পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া কিছুই বলা সম্ভব না। এটি পৃথিবীতে ৫ম রোগী পাওয়ার ঘটনা। তাও একই পরিবারের ৩ জনকে পেয়েছি। আমরা তাদেরকে ভর্তি করে নিয়ে শুধু ব্যাথানাশক ওষুধ প্যারসিটামল দিচ্ছি। আগামীকাল (আজ) তাদের কে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরন করবো।

অপরদিকে রামনাথপুর ইউপির চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন- আমি তাজুলকে একটি হুইল চেয়ার দিয়েছি। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন- চিকিৎসাটি ব্যয় বহুল। এ জন্য একটি ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন। আমরা সমাজসেবা বিভাগের অধীনে সর্বোচ্চ সেবা দেবো। পাশাপাশি তাদের দু’ভাই (বাছেত, তাজুল)কে পঙ্গুভাতা দিচ্ছি। বাছেতকে একটি হুইল চেয়ার দেয়া হয়েছে। আগামীতে শিশু রুবেলকেও পঙ্গুভাতা দেয়া হবে। তিনি সমাজের বিত্তবানদেরকে অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে আহ্বান করছি।




(জিকেবি/এস/মার্চ০৯,২০১৬)