বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম ও ১২ আউলিয়ার শহর চট্টগ্রামে (পূর্ব নাম ইসলামাবাদ) অনেক বার আসা হলেও কেবল আত্মীয় স্বজনদের বাসায় দাওয়াত খেয়ে বা পার্বত্য অঞ্চলে ট্যুরের ট্রানজিট হিসেবে কিছুদিন থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছি। তাই এবার রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি ট্যুর শেষে চট্টগ্রাম এলাম ভ্রমনের উদ্দেশ্য নিয়েই।

নামকরণ :

ধারনা করা হয় চট্টগ্রামের নাম করন করা হয় আরবি শব্দ "শাত" বা বদ্বীপ এবং "গঙ্গা " শব্দ থেকে। আবার উইকিপিডিয়া থেকে ৯৫৩ সালে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম অভিযানে আসলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এটির গায়ে লেখা হয় ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। সে থেকে এ এলাকাটি চৈত্তগৌং হয়ে যায় বলে লেখা হয়েছে আরাকানীয় পুথি ‘রাজাওয়াং’-এ। এ চৈত্তগৌং থেকে কালক্রমে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি বানানের চল হয়েছে

ইতিহাস :

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ট্রো-এশিয়াটিকরা এখানে বসবাস করলেও পরবর্তীতে তারা মঙ্গলীয়দের দ্বারা বিতারিত হয়। অনেকে মনে করেন প্লিনির লিখিত গ্রিক ভৌগোলিকে ক্রিস নামে যে স্থানের বর্ণনা রয়েছে সেটি বর্তমানের সন্দীপ। দশম শতকে আরবীয় বনিকদের চট্টগ্রামে আগমন ঘটে। কিন্তু ১৩৩৮ সালে সুলতান ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ‌-এর চট্টগ্রাম বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইতিহাস অস্পষ্ট।
১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন -“বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমূদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ...আমি সোদওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।
* ১৫১৭ সাল থেকে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসে।
* ১৫৩৮ সালে শের শাহ‌-র সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করে
* ১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে শাসিত হয়
* ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগলদের হস্তগত হয়।
* পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মীরজাফর কোনভাবেই ইংরেজদের চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে রাজী হোননি।১৭৬১ সালে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব হয়ে ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম হস্তান্তরিত করেন।
* ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
* ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করলেও বিজয়ের একদিন পর চট্টগ্রাম শহর শত্রুমুক্ত হয়

কর্ণফুলী নদীঃ
এটি ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীর মোহনাতে বাংলাদেশের প্রধান সমূদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার।
** কর্ণফুলী নদীর নামের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তাঁরা দুই জন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিলেন। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হন নি। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় 'কর্ণফুলী। মার্মা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং।

চট্টগ্রাম শহরে প্রথমঃ
*১৮৬৯ সালে প্রথম কলেজ স্থাপিত হয়। এটিই পরবর্তীকালে বর্তমান চট্টগ্রাম কলেজের রূপ নিয়েছে
* ১৯০১ সালে প্রথম পাবলিক হাসপাতাল (চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল) প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ১৯১৯ সালের নভেম্ভর ২৯: সকাল ১১.৪৫ মিনিটে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের আকাশে বিমান উড়তে দেখা যায়।
* ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রামে প্রথম হোমিওপ্যাথিক কলেজ স্থাপিত হয়।
* ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের সড়কে প্রথম সাইকেল রিকশার চলাচল আরম্ভ হয় এবং শহরের প্রথম বাস-সার্ভিস চালু হয়।
* ১৯৫৪ সালের ২২ জুন সার্কিট হাউসে জরুরি উপগ্রহ রেডিও স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রথম বেতার সম্প্রচর শুরু হয়।
* ১৯৬২ সালে অটোরিকশা (বেবিট্যাক্সি) প্রথম চালূ হয়।
< চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ী ড.মুহম্মদ ইউনুস>

কিভাবে জাবেনঃ
>> বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ২০ মিনিটের মত লাগে, জি এম জি, ইউনাইটেড এয়ার সহ বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও ট্রানজিট ফ্লাইট আছে।
UNITED AIRWAYS FARE CHART
REGENT AIRWAYS
>> ট্রেনে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে অনেক গুলো ট্রেন ছেড়ে যায় , সুবর্ণ, মহানগর প্রভাতি , মহানগর গোধূলি, তুরনা নিশিতা , চট্টগ্রাম মেইল, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস
ভাড়া সহ বিস্তারিত
>> গ্রীন লাইন, সাউদিয়া এস আলম, হানিফ এন্টারপ্রাইজসহ অনেক এসি / নন এসি বাস যাতায়াত করে থাকে। আরামবাগ, সায়েদাবাদ হতে চট্টগ্রামগামী বাস পাওয়া যায়। এসি - ৯০০/- টাকা হতে শুরু, নন এসি - ৫০০/- টাকা হতে শুরু।
সৌদিয়া পরিবহন ০১৯১৯৬৫৪৯২৯ , এস. আলম পরিবহন ০১৯১৭৭২০৩৯৫ , ইউনিক সার্ভিস ০১১৯১৬২১১২৭

চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াতঃ
চট্টগ্রাম শহরে রিক্সা ভাড়া একটু বেশি, বেশির ভাগ রাস্তাই ঢালু রিক্সা চালানো বেশ কষ্টকর। সিএনজি ভাড়া ঢাকার চেয়ে একটু কম। তবে বাস সার্ভিস খুব ভালো। যে কোন জায়গায় বাসে যেতে পারবেন। পর্যাপ্ত পরিমানে আছে। ভাড়াও কম। বিশেষ করে দর্শনীয় স্থান সব গুলোই বাসে যেতে পারেন সিংহ ভাগ রাস্তা। পরে কিছু পথ রিক্সা লাগতে পারে। শহরতলী বাস গুলো মূলত বহদ্দার হাট বা নতুন ব্রিজ থেকে শুরু হয়। নিম্নে বাসের রুট গুলো দিয়ে দেয়া হলো , সহযোগিতা করায় বিশেষ কৃতজ্ঞতা
(হৃদয়ে চট্টগ্রাম) আরা বেয়াজ্ঞুন চাটগাঁইয়া !!


১ নং বাস:
নিউ মার্কেট - লালদীঘি - আন্দরকিল্লা - চন্দনপুরা - চকবাজার - বাদুড়তলা - বহদ্দারহাট ।
২ নং বাস:
নিউ মার্কেট - লালদীঘি - আন্দরকিল্লা - গণি বেকারী - চকবাজার - প্রবর্তক - ২ নং গেট - মুরাদপুর - বহদ্দারহাট - কালুরঘাট ।
৩ নং বাস:
নিউ মার্কেট - কাজীর দেউরী - গোলপাহাড় - প্রবর্তক - ২ নং গেট - বিবিরহাট - অক্সিজেন - চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।
৪ নং বাস:
নিউ মার্কেট - টাইগার পাস - লালখান বাজার - দামপাড়া/জিইসি - ঝাউতলা - একে খান - ভাটিয়ারী ।
৫ নং বাস :
লালদীঘি - নিউ মার্কেট - টাইগার পাস - দেওয়ান হাট - আগ্রাবাদ - বারেক বিল্ডিং - সল্টগোলা - ইপিজেড - বন্দরটিলা - সিমেন্ট ক্রসিং - মেরিন একাডেমী - বিমানবন্দর ।
৬ নং বাস :
লালদীঘি - নিউ মার্কেট - টাইগার পাস - দেওয়ান হাট - আগ্রাবাদ - বারেক বিল্ডিং - সল্টগোলা - ইপিজেড - বন্দরটিলা - সিমেন্ট ক্রসিং - কাঠগড় - সী বিচ ।
৭ নং বাস:
লালদীঘি - নিউ মার্কেট - দেওয়ানহাট - বাদামতলী মোড় (আগ্রাবাদ) - বড়পুল - অলংকার - ভাটিয়ারী ।
৮ নং বাস:
লালদীঘি - নিউ মার্কেট - টাইগার পাস - লালখান বাজার - জিইসি - ২ নং গেট - বায়েজিদ বোস্তামী - অক্সিজেন ।
১০ নং বাস:
নতুন ব্রীজ - বহদ্দারহাট - মুরাদপুর - ২ নং গেট - জিইসি - লালখান বাজার - টাইগার পাস - দেওয়ানহাট - আগ্রাবাদ - বারেক বিল্ডিং - সল্টগোলা - ইপিজেড - বন্দরটিলা - সিমেন্ট ক্রসিং - কাঠগড় ।
১০/এ নং বাস:
কালুরঘাট - বহদ্দারহাট - মুরাদপুর - ২ নং গেট - জিইসি - লালখান বাজার - টাইগার পাস - দেওয়ানহাট - আগ্রাবাদ - বারেক বিল্ডিং - সল্টগোলা - ইপিজেড - বন্দরটিলা - সিমেন্ট ক্রসিং - কাঠগড় ।
(উপরোক্ত রুট লিস্ট ৯৫% নির্ভুল । এর বাইরেও ২-১ টি রুট থাকতে পারে, যেমন ১১ নং বাস । তবে মূল শহরে এগুলোই প্রধান)

কোথায় থাকবেনঃ
হোটেল আগ্রাবাদ(৫ তারকা)
পেনিনসুলা (৩ তারকা)
হোটেল এশিয়ান
এছাড়াও ষ্টেশন রোডে এবং বহদ্দার হাটে মধ্যম মানের অনেক গুলো আবাসিক হোটেল আছে।

খাবারদাবারঃ
মেজবানের গোশত ও আখনি বেশ নামকরা। আখনি হলো তেহেরির মত। জিএসসি মোড়ে, লাল খান বাজারে ভালো ভালো অনেক চাইনিজ, বুফে, ফাস্টফুড ও পেস্ট্রি দোকান আছে। নাসিরা বাদে সানমার মার্কেটের উপরে ফুড কোর্ট রয়েছে। হাইওয়ে এর কেক খেতে ভুলবেন। ঢাকাতেও এত টেস্টি কেক পাবেন না। নিউমার্কেটের ২য় তলায় ডায়মন্ড অনেক পুরানো ও নামকরা রেস্টুরেন্ট। বুফে খেতে যেতে পারেন অ্যামব্রোসিয়া । আমি বলবো এক কথায় অসাধারণ। তবে মেরিডিয়ানেরতাও খারাপ না।

চট্টগ্রামের ট্যুরিস্ট স্পট গুলো সহজে খুঁজে নিনঃ
বহদ্দার হাটকে কেন্দ্র ধরে নিলে ,
> বহদ্দার হাট বাস টার্মিনালের উল্টা দিকে স্বাধীনতা কমপ্লেক্স (২৪ তলার উঁচুতে রেস্টুরেন্ট ও মিনি বাংলাদেশ) ,
> বহদ্দার হাট থেকে সোজা মুরাদপুর মুরাদপুরের ডানের রাস্তা হাটহাজারি তথা রাঙ্গামাটির বাস টার্মিনাল তথা অক্সিজেন মোড় , বামের রাস্তা দিয়ে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্ক এবং আরও বেশ কিছু দুর গেলে চেরাগি পাহাড়, ডিসি হিল।
> মুরাদপুর থেকে সোজা ২ নম্বর গেট। ২ নম্বর গেট থেকে ডানে বায়োজিদ বোস্তামি (র) মাজার। মাজার থেকে সোজা অক্সিজেনের মোড়। অক্সিজেন হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
> ২ নম্বর গেট থেকে সোজা জিইসি মোড়। জিএসসি মোড় থেকে বামে গোল পাহাড় এখানে বাদশা মিয়া রোডের মাথায় ওয়ার সিমেট্রি। ডানের রাস্তা চলে গেলো ফয়েস লেক ও চিড়িয়াখানা হয়ে ভাটিয়ারী সীতাকুণ্ড।
> জিইসি মোড় থেকে সোজা যেতে থাকলে হাতের ডানে পরবে গরীবুল্লাহ শাহ (র) মাজার।
> জিইসি মোড় ছাড়িয়ে ওয়াসার মোড়ে পরবে জামাতুল ফালাহ মসজিদ। মসজিদ থেকে সোজা ডানে আলমাস ও ঝুমুর সিনেমা হল।
> ওয়াসা মোড় থেকে সোজা ইস্পাহানি সার্কেল । এটাই লাল খান বাজার। এই মোড় থেকে বামে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, শিশু পার্ক ও এম এ আজিজ স্টেডিয়াম।
> লাল খান বাজার থেকে সোজা টাইগার পাস। টাইগার পাসের বামের রাস্তা রেলওয়ে শত বছর পুরানো সিআরবি ভবন। ভবন থেকে সোজা কদমতলি ছাড়িয়ে রেল ষ্টেশন। ষ্টেশন থেকে সোজা নিউমার্কেট। নিউমার্কেট থেকে সোজা কোতয়ালি মোড় থেকে বামের রাস্তায় লাল দিঘি। লাল দিঘির কাছেই শাহ আমানত (র) মাজার।
> টাইগার পাস থেকে সোজা আগ্রাবাদ বাদামতলি মোড় গিয়ে বামের রাস্তায় এগুলে জাতিসত্ত জাদুঘর।
> আগ্রাবাদ থেকে সোজা পোর্ট , পতেঙ্গা সি বীচ।
(ওএস/এস/মার্চ২৪,২০১৬)