সোনা কান্তি বড়ুয়া, টরন্টো থেকে : নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ঢাকার বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার (২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সন্মানিত অতিথি হিসেবে তাঁর ভাষণে চর্যাপদের (৪৯ নম্বর কবিতার মিথ্যা ব্যাখ্যা করেন) বাঙালি কবি ভুসুকুপাদকে অপমানিত করেন এবং বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে ইসলামিক হিজরি (১৪৩২) সালকে  হিন্দুত্বকরণে বঙ্গাব্দের (১৪১৮) মিথ্যা ইতিহাস বর্ণনা করেন।

হিন্দুরাজনীতি বঙ্গাব্দের বাংলা পঞ্জিকা রচনায় হিজরি সালকে ভাড়া করে এনে সূর্য্য ক্যালেন্ডারের দোহাই দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের চোখে ধোকা দেয় এবং ইসলামিক হিজরি সালকে বিকৃত করে বঙ্গাব্দ রচনা করার মিথ্যা ইতিহাস বর্ণনা করেছে।

সম্প্রতি বাংলা নববর্ষ সম্বন্ধে বিবিধ প্রবন্ধ পড়ে আমরা জানতে পারলাম যে ১৫৫৬ খৃষ্ঠাব্দ থেকে মোগল সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলাদেশে বাংলা সন প্রচলিত হয়। প্রসঙ্গত: প্রতিবছর নববর্ষ উপলক্ষে ১৪ বা ১৫ই এপ্রিল জুড়ে থাইল্যান্ড, লাওস, বার্মা, ভারত, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিংগাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় “পানি খেলা সহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সোনার বাংলার অন্যতম শাসক মহাবীর ঈশা খাঁ সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো।

সম্রাট আকবরের আমলে হিজরি সালকে (চান্দ্র ক্যালেন্ডার) অনুসরন করে জানা বঙ্গাব্দের অজানা ইতিহাস আমরা হিন্দু রাজনীতির (সৌর ক্যালেন্ডার) ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রে ভুলে আছি। ১৪৩৭ হিজরি ১৪২২ বাংলা বা বঙ্গাব্দ হয় কি করে? যুজুর ভয়ে নৌকা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে। আমরা আরব দেশে গিয়ে আজ ১৪২২ হিজরি সাল বলতে পারি না। এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যা দিয়ে বঙ্গাব্দের ইতিহাস রচিত হলো অথচ আমাদের জাতীয় বিবেকের জবাবদিহিতার শক্তি মরে ধর্ম নামক বিভিন্নভয় ভীতির কবলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দুরাজনীতির খাঁচা ভাঙতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন। যার ফলে পশ্চিম বাংলায় আজ ও বুদ্ধ পূর্ণিমায় সরকারি ছুটি নেই।

চান্দ্র ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে দিওয়ালী, দূর্গা পূজা সহ সকল হিন্দু উৎসব সম্পন্ন হলে হঠাৎ করে ইসলামিক হিজরি সালের জন্য চান্দ্রমাস বাদ দিয়ে সূর্য ক্যালেন্ডারের নাম দিয়ে হিজরি সালকে হিন্দুত্বকরণ করে বঙ্গাব্দ করা হ’ল কেন? হিন্দুরাজনীতি সম্রাট অশোক ও পাল রাজত্বের বুদ্ধাব্দকে কবর দিয়ে ঢাকায় অমর্ত্য সেনের উক্ত ভাষনই রাজনৈতিক দলিল।

আইনের শাসনে ভারতের অজন্তা গূহায় “বিজয় সিংহ এর সিংহল অভিযানের স্বাক্ষর বিরাজমান (চিত্র নম্বর ৫৩)” সত্বে ও ১৪১৮ বঙ্গাব্দ লেখা অন্যায় ও অসঙ্গত। সিংহল অভিযানের প্রানপুরুষ বিজয় সিংহ এর জন্ম তারিখ বা তাঁর ঠিকুজি বঙ্গাব্দের বাইরে কেন? ইতিহাস তো ছেলের হাতের মোয়া নয়। ২৬০০ বছর পূর্বে শ্রীলংকার মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ শীর্ষক ঐতিহাসিক গ্রন্থদ্বয়ের মতে রাজা বিজয় সিংহ বাঙালি ছিলেন । আজ ১৪২২ বঙ্গাব্দ লেখা হয় হিজরি (১৪৩৭) সালকে বিকৃত করে।

বিগত ৬ই মে ২০১২ সালে আনন্দ বাজার পত্রিকা তার কার্টুনে (রবিবাসরীয়, শেখর মুখোপাধ্যায় গোলমেলে গিন্নি) লেখা ছিল, “হ্যাঁ রে, আজ না কি বুদ্ধ পূর্ণিমা? বলিস কী, এখনও নাম বদলায় নি?” কথায় বলে (আনন্দবাজার পত্রিকা বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে জেনে শুনে ), “চিনির বলদ চিনি টানে, চিনে না চিনি।

উক্ত কার্টুনের ভাষা বিশ্ব বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুভূতির মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছে। নাম বদলানোর ইতিহাসে আনন্দবাজার পত্রিকা সহ হিন্দুরাজনীতির জুড়ি নেই। পশ্চিমবঙ্গে বোধিসত্ত্ব তারাদেবীর (চীন ও তিব্বতের বৌদ্ধ দেবী) নাম বদলিয়ে বন্দে মাতরমের ভারতমাতা দূর্গা, কালী, চন্ডী নাম রাখা হলো এবং হিন্দুরাজনীতিচক্র বৌদ্ধধর্মকে অপহরণ করে পরম পূজনীয় অবলোকিরেশ্বর বোধিসত্ত্বকে শিব বানিয়ে বৌদ্ধ সভ্যতার অস্তিত্বকে চিরতরে বিলীন করার গভীর ষড়যন্ত্রের ইতিহাস রচনা করেছিল।

প্রসঙ্গত, হিন্দুরাজনীতি ১৪৩৩ হিজরিকে সূর্য্য ক্যালেন্ডার দিয়ে বদলিয়ে ১৪১৯ বঙ্গাব্দ হলো এবং বৌদ্ধদের ধর্মচক্রকে বদলিয়ে সারনাথের অশোক চক্র বানিয়ে ভারতের “রাষ্ট্রীয় প্রতিক” করেছে। দশরথ জাতককে হিন্দুপন্ডিতগণ বদলায়ে রামায়ণ রচনা করার পর উক্ত রামায়নের অযোধ্যা কান্ডের বত্রিশ নম্বর শ্লোকে গৌতমবুদ্ধকে চোর এবং বৌদ্ধদেরকে নাস্তিক বানিয়েছে। এই ঐতিহাসিক রক্তাক্ত প্রান্তরের স্বাক্ষী বাংলা ভাষার আদিমতম নিদর্শন বৌদ্ধ চর্যাপদ।

প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে, বাংলা বর্ণমালার ইতিহাসে প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতমবুদ্ধ বাল্যকালে যে বাংলা লিপি অধ্যায়ন করেছিলেন তা বাংলা বিশ্বকোষে (১৩শ ভাগ, পৃঃ ৬৫ ) সগৌরবে লিপিবদ্ধ এবং ইতিহাসে দেদীপ্যমান হয়ে আছে। বিংশ শতাব্দীর আটচলিশ সাল থেকে বায়ান্নোর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী আমি কি ভুলিতে পারি? বঙ্গাব্দ থেকে বুদ্ধবর্ষকে সরাতে হিন্দু রাজনীতি গভীর ষড়যন্ত্র করে (১৪৩২ হিজরি সালকে ১৪১৮ বঙ্গাব্দ) এবং ইসলামিক হিজরি সালকে বিকৃত করে বাংলার ইতিহাসকে হিন্দুভাবাপন্ন করে গড়ে তোলে। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদ আবিস্কার হওয়ার পর হিন্দুত্বের ঝুলি থেকে ষড়যন্ত্রের বেড়াল বের হয়ে প্রমানিত হলো “বাংলা ভাষা পালি ভাষার বিবর্তিত রুপ।” হিন্দুরাজনীতি কিন্তু গৌতমবুদ্ধকে তাঁদের নবম অবতার বানিয়ে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে বৌদ্ধ ত্রিপিটককে (বুদ্ধবংশ) অস্বীকার করতে রামায়ণের অযোধ্যা কান্ডে (অধ্যায়ে) ৩২ বত্রিশ নম্বর শ্লোকে বৈদিক পন্থী হিন্দু পন্ডিতগণ বুদ্ধ এবং বৌদ্ধদেরকে যে ভাবে গালাগাল করেছেন তা অমানবিক এবং অধর্ম ।

অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে বঙ্গাব্দের মিথ্যা ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করা নিতান্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্রধর্ম নিতান্ত ভয়ঙ্কর কারন পাল রাজত্বের পর প্রাচীন বাংলায় হিন্দুধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় বৌদ্ধধর্মকে কবর দিয়েছিল। বাংলায় বুদ্ধের বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ জন্ম গ্রহন করেছিল। কিন্তু হিন্দু রাজনীতি “সাপ ও না মরে, লাঠি ও না ভাঙে” নীতি দিয়ে চান্দ্র বর্ষ ১৪৩২ (১৪৩৭) ইসলামিক হিজরি সালকে বিকৃত করতে সৌর ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেছিল। তাই আজ ১৪১৮ (১৪২২) বঙ্গাব্দ রচনায় বঙ্গাব্দের মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে বাংলা ক্যালেন্ডারের মস্তক বিক্রয় করে চলেছে। সদা ভয়, সদা লাজে বাঙালি লেখকগণ জানা বঙ্গাব্দের অজানা কথা আলোচনা করতে ভয় পায়।

বৈদিকপন্থী হিন্দু পন্ডিত, লেখক ও সন্ন্যাসীগণ ‘অহিংসা পরম ধর্ম ’ প্রচার না করে দলিত জনতার মানবাধিকার কেড়ে নিতে মিথ্যা পুরাণ সাহিত্য, ইতিহাস এবং আল্লাহ উপনিষদের মতো মনগড়া উপনিষদ রচনা করেন। হাজার হাজার বছর যাবত বৈদিক হিন্দুধর্ম এবং রাজনীতি মানবাধিকার বিরোধী ‘বর্ণাশ্রম বা জাতিভেদ প্রথার’ মাধ্যমে দক্ষিন এশিয়ায় দুর্নীতি বা ভ্রষ্টাচারের বীজ বপন করতে মানবাধিকারবাদী সিন্ধু সভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস করেন।

দিনের পর দিন হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধহত্যা যজ্ঞ (দেশ, ৪ মে ২০০১ পৃষ্ঠা ১২ কলকাতা এবং সম্পাদকীয় ২২ আগষ্ট ১৯৯৩ আনন্দবাজার পত্রিকা) সহ গৌতমবুদ্ধের ঐতিহাসিক পবিত্র জন্মভূমি নেপালের ‘লুম্বিনী উদ্যান’ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র রচনা করে চলেছে । ভারতীয় ও নেপাল সীমান্তের নদীতে বাঁধ দিয়ে সম্রাট অশোকের ঐতিহাসিক বুদ্ধ বন্দনার অশোক স্মৃতিস্তম্ভ সহ বুদ্ধের মাতা মহামায়া মেমোরিয়াল মন্দির, পুরাতত্ব সংগ্রহ শালা, কোটি কোটি ডলারে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার এবং লুম্বিনী শহর পানির অতল তলে তলিয়ে যেতে গভীর ষড়যন্ত্র রচনা করার সংবাদ দেশে বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা বর্ণমালা যে কতো পুরানো তা ইতিহাস আমাদেরকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক হরলাল রায় তিনি তাঁর লেখা ‘চর্যাগীতি’ গ্রন্থের দশম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘ধর্মকোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। বাঙালী সমাজের এই করুণ ছবি দেখতে পাই ৩৩ নং চর্যায়। ‘‘টালত মোর ঘর নাঁহি পড়বেসী। হাড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী। এর মানে, নিজ টিলার উপর আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নাই, অথচ নিত্য ক্ষুধিত।” নিজ বাসভূমেই পরবাসী করে দিয়েছে বাঙালীকে। ইতিহাসের এই অন্ধকার যুগে তবু বাঙালী দু’হাতে অনন্ত সমস্যার পাথর সরিয়ে জীবনের যাত্রা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল অন্যতর আলোর লক্ষ্যে।

আজ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হয়ে ও বাংলা লিপি এবং ভাষার জন্যে প্রাণ দান করার পর শহীদদের জন্যে জাতীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীন বাংলাদেশের জনম সার্থক হয়েছে। জয় বাংলা।

ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শেখড়ের সন্ধানে ইহা ও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উলেখযোগ্য যে, আমরা ‘বৌদ্ধ চর্যাপদের’ সন্ধান পেলাম আজ থেকে ১০২ বছর আগে। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালায় প্রাচীন পান্ডুলিপির সন্ধান করতে গিয়ে মহামহোপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় উক্ত বৌদ্ধ চর্যাপদের মরমী সংগীতগুলো আবিস্কার করেন এবং ভাষা আন্দোলনের আলোকে চর্যাপদ সন্ধানের (১৯০৭- ২০০৭) শতবার্ষিকী ছিল। পরে “চর্যাপদ” সম্বন্ধে গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন, ডঃ সুনীতি কুমার চাট্টোপাধ্যায়, ডঃ মোহাম্মদ শহীদুলাহ, ডঃ প্রেবোধ চন্দ্র বাগচি, ডঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন, ডঃ সুকুমার সেন, ডঃ মনীন্দ্রমেহন বসু, ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত, ডঃ তারাপদ মুখার্জী, ডঃ অতীন্দ্র মজুমদার, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত পার কভিরনে সহ আর, ডঃ আহমদ শরীফ, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ হাসনা জসীমউদ্দীন (মওদুদ) ও অনেক বিখ্যাত গুণীজন। মুনিদত্ত চর্যাপদ তিব্বতি ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন।

বৌদ্ধ পাল রাজত্বের পতনের যুগে এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান কালে অস্থির ঘটনা চাঞ্চল্যের দ্বারা চঞ্চল সেন বর্মন রাষ্ট্রের প্রবল আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে চর্যাপদের জন্ম আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারের মেনিফিষ্টো হিসেবে। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালীর সর্বপ্রথম গনতন্ত্রের বীজ ‘বাক স্বাধীনতার অধিকার’। বাংলা ভাষার প্রথম ‘বিপ্লবী মিনার’। বৌদ্ধ কবি ও সাধকগণ বিপুল প্রজ্ঞা ও ক্ষুরধার বৌদ্ধদর্শন প্রয়োগ করে মনুষ্যত্বের উন্মেষ বিকাশে চর্যাপদের (৮ম - ১২শ শতাব্দী) এক একটি কবিতা রচনা করতেন। মানুষের দেশ মানুষের মনেরই সৃষ্টি।

(ওএস/এএস/মার্চ ৩০, ২০১৬)