রবিশঙ্কর মৈত্রী


রবীন্দ্রসংগীত গাইলেই শান্তিপূর্ণ সুন্দর মানুষ হওয়া যায় না। শিল্পী কবি লেখক হলেই মানুষ উদার হয় না। আমি আবৃত্তি করি বলেই নিজেকে শতভাগ শুদ্ধ মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারি না। আমারও অতিসাধ ছিল, অতিইচ্ছা হয়েছিল-- মনে হয়েছিল গানবাংলা টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতির বিকাশ ঘটাব। কিন্তু কজন অতি উচ্চাকাঙক্ষী মানুষ নিয়ে গানবাংলা করতে গিয়ে আমি নিজেই আজ বাংলা ছাড়া।

বাংলাভিশনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় সিইও মোস্তাফিজুর রহমান, অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান শামীম শাহেদ সহ চ্যানেলের সবাই আমার আবৃত্তিকর্মকে উৎসাহ দিয়েছেন। আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান আমার সংস্কৃতিচর্চাকে শ্রদ্ধা করতেন। আরটিভির প্রোগ্রাম ম্যানেজারের দায়িত্বপালন কালে অনেক অনুষ্ঠানেই আবৃত্তিকারদের অংশগ্রহণের জন্য আশিক ভাই-ই আমাকে পরামর্শ দিতেন।

বাংলাভাষার যে-কোনো শব্দের সঠিক উচ্চারণ বানান অর্থ জানতে চেয়ে কতোজন যখন তখন আমাকে ফোন করতেন।
বন্ধু আহকাম হয়তো বলল, ‘‘রবি, মে দিবসে রবীন্দ্রনাথের কী পড়া যায়?” আমার সহজ উত্তর : ‘‘ওরা কাজ করে। বিশ্বভারতীর সঞ্চয়িতায় দেখো-- পৃষ্ঠা ৮৩১।” আহকাম হয়তো বলল-- ‘‘দোস্ত দুইটা লাইন শোনাও।’’ আমি ফোনেই শুরু করেছি---
ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল। / ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে / পাকা ধান কাটে--/ ওরা কাজ করে / নগরে প্রান্তরে।’’

কতো আবৃত্তিজনের আশা ভরসা ছিলাম আমি। দেশের শত শত আবৃত্তিপ্রেমী বন্ধুর কাছে কী জবাব দেব আজ? কতোজন আজও ফেসবুকে ইনবক্সে প্রশ্ন করেন-- রবিদা কবে দেশে আসবেন? আমি বলি, আমার স্ত্রীর ক্যানসার। ফরাসি দেশে তার চিকিৎসা চলছে। আমি আসব, আসছি। তোমরা অপেক্ষা করো।
কিন্তু ১২ই এপ্রিল ২০১৬ তারিখে দেলোয়ার হোসেন রাজা--- আপনি কী করলেন? আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের করলেন কেন?
আঙ্কেল, আপনি নাকি আমাকে পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করেন-- এমনটাই বলেছিলেন একদিন। আপনার সুপুত্র কৌশিক হোসেন তাপস আর আমাকে অভিন্ন জ্ঞান করতেন। কিন্তু আমি কী এমন অন্যায় করলাম-- আপনারা আমার নামে ২০১৪ সালের ৭ই এপ্রিল ভয়া্বহ মিথ্যা মামলা দিলেন। আমাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে টাকা সাধলেন। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের নাম বলে আমাকে ভয়া দেখালেন। আমি ২০১৪ সালের ১৮ই এপ্রিল পালিয়ে ভারতে চলে গেলাম। ফিরে এলাম ৯ই জুন ২০১৪ তারিখ রাতে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিজেদের বাসায় না গিয়ে অন্য এক বাসায় লুকিয়ে থাকলাম। দুমাস পরে দেশে ফিরে সেই রাতে আমি সারা রাত কেঁদেছিলাম। পরদিন সকালে আমারই আবৃত্তিশিষ্য অ্যাডভোকেট খায়রুল আহসান সোহাগের মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছিলাম। আদালত জামিন মঞ্জুর করেছিল। তারপর প্রতিবার হাজিরাতেই আমি ছিলাম আদালতে। সর্বশেষ হাজিরা দিয়েছি ২৩শে অক্টোবর ২০১৪ তারিখে।
মামলা, হামলা, হুমকি, চাকরিহীন আমি-- অভাবে পড়ে ঘরের পুরোনো বই নীলক্ষেতে বিক্রি করে পাঁচ কেজি চাল কিনে এনে খাওয়া। কী দুঃসহ অভাব অনটন আর মৃত্যুভয় তাড়িত দুর্বিষহ জীবন তখন। আর পারছিলাম না। অনেক ধারদেনা করে, গ্রামে বাবার জমি বন্ধক রেখে শেষকালে ২৬শে অক্টোবর ২০১৪ তারিখে সপরিবারে দেশত্যাগ করে প্রথমত ইতালিতে আসি। তারপর গত ৭ই নভেম্বর ২০১৪ তারিখে ফ্রান্সে। ফ্রান্সে এসে ডাস্টবিন থেকে ডেটওভার স্যান্ডউইচ খেয়েছি। ফরাসি সরকারের দেওয়া হোটেলের এক রুমে থেকেছি চার জনে মিলে। শীতের দেশে কী যে গভীর কষ্টে কেটেছে আমাদের। আর আপনারা আমার নামে চরম বদনাম প্রচার করেছেন-- আমি চ্যানেল বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ছিঃ ঘেন্না ধরে যায়, বাঙালি এতো নোংরা বীভৎস হতে পারে? আজিমের কাছ থেকে আপনারা কয়েক কোটি টাকা নিয়েছিলেন-- কিন্তু তাকে শেয়ার দিতে পারেননি বলেই এতো জ্বালা-- আমারই কারণে।
২রা ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে গানবাংলার কোনো বোর্ড মিটিং হয়নি। অথচ আপনারা ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে ফর্ম ১১৭, ৯, ১২ এসবে ভুয়া স্বাক্ষর বসিয়ে কী সব করে নিয়ে জয়েন্ট স্টকে জমা দিয়েছেন। সেই সব ভুয়া কাগজপত্র তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে দেখিয়ে গানবাংলার সবকিছু নিজেদের করে নিয়েছেন। ইনুভাইকে এতো ধোঁকা দিতে পারলেন আপনারা? আপনারা তাঁর পার্টির লোক হয়ে তাঁকেই এতো ঠকালেন? ধোঁকা দিলেন বিটিআরসিকে। ধোঁকা দিলেন শ্রদ্ধেয় শেখ কবীর হোসেনকে (তাঁকে সবাই আমরা কবীর চাচা বলেই শ্রদ্ধা করি)।
এখনো যদি গানবাংলা টেলিভিশন ভালোভাবে চলত-- আমি স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে প্রবাস থেকে শান্তিই পেতাম।
আমি এখনো শান্তিই চাই। কিন্তু আপনারা আমার জামিন বাতিল করার আবেদন করে আমার দেশে ফেরাটাই বন্ধ করে দিলেন। আমি এখনো শান্তি চাই। আপনারা দোষ স্বীকার করুন। ভুল স্বীকার করুন। আমার উপরে আপনারা চরম অন্যায় করেছেন-- চরম সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছেন। নিজেদেরকে শুধরে নিন। আমাকে দেশে ফিরতে দিন। এবং আমার নিজের দেশে আমাকে নিরাপদে সাংস্কৃতিক কর্ম করতে দিন।
উন্নত দেশে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদে বাস করার মানুষ আমি রবিশঙ্কর মৈত্রী নই।

আমার বিরুদ্ধে মামলা হামলা জেল জুলুম নিয়ে কদিন ধরে বিস্তারিত লিখছি। আমার প্রতি সহানুভূুতিশীল হয়ে উঠেছেন অনেকেই। প্রকৃত সত্য উন্মোচিত ও আবিষ্কৃত হচ্ছে ধীরে ধীরে। দায়িত্বশীল ক্ষমতাবর্তী মমতাবান কজন মানুষ আমার পাশে এরই মধ্যে দাঁড়িয়েছেন।
আমি এখনো্ পূর্ণ সত্য প্রকাশ করিনি। ২০১১ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৫শে অক্টোবর মধ্যরাত অব্দি আমার জীবনে গানবাংলা নিয়ে যতো সুখ দুঃখের ঘটনা ঘটেছে সবই প্রকাশ করব, একে একে। গানবাংলা নিয়ে আমি বই প্রকাশ করব। শুধু বাংলাভাষায় নয়, বাংলা ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষায় গানবাংলা এবং আমার দেশত্যাগের ঘটনা অক্ষরে অক্ষরে লিখব। কবে কবে গানবাংলার পক্ষ থেকে আমি নিজে বিটিআরসিতে তরঙ্গ বরাদ্দের টাকা জমা দিয়েছি-- সবই আমাকে লিখতে হবে।