রায়পুর(লক্ষ্মীপুর)প্রতিনিধি :এক সময় রায়পুর উপজেলায় মানুষের খাদ্য তালিকায় দেশীয় মাছের নাম ছিল সর্বাগ্রে। এ মাছে পুষ্টি ও খাদ্য গুণাগুণ ছিল অনেক বেশি। ছোট-বড় দেশীয় মাছ সবার কাছে ছিল অতি প্রিয়। মাছের তালিকায় ছিল বোয়াল, মলা, পুঁটি, চেলা, বাইন, পাবদা, সিং, মাগুর, কৈ, শোল, টাকি, খলিশা, টেংরা,আইড়, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, ইত্যাদি। বছর দশেক আগেও উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে পাওয়া যেত অনেক রকম দেশী প্রজাতির ছোট মাছ। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে মাঝে-মধ্যে যাও বা কিছু আমদানি হয় তাও আবার চলে যায় ভাগ্যবান পয়সাওয়ালাদের বাজার ব্যাগে।

এসব মাছের দাম অত্যন্ত চড়া হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যে এসব মাছ আর জুটছে না। দিন যতই যাচ্ছে এ এলাকা থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

গত দুই দশকে শতাধিক প্রজাতির মাছ পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলে দেশীয় মাছের আকালসহ উৎপাদনও দিনকে দিন কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা,নদী-নালা, খাল-বিল, গর্ত-ডোবা ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, ছোট বড় জলাশয় সেচে মাছ ধরা, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধনকারণে এ অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। সিডর, আইলাসহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত এ এলাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছের চাষও বিপর্যয়ের মুখে পড়ার কারণে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে । আশংকা করা হচ্ছে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না চিরতরে হারিয়ে যাবে দেশীয় মাছের ঐতিহ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ছোটমাছ না ধরে প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ করা, ডিমওয়ালা মাছ প্রকৃতিতে অবমুক্তকরণ, ছোট মাছের উপকারিতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, জেলে পরিবারগুলোকে এসব মাছ মারার পরিবর্তে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, কীটনাশকের মাত্রারিক্ত ব্যবহার কমাতে পারলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে । না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবে প্রকৃতিক উৎসের নানা প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। বিপন্ন হবে আপন কৃষ্টি, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য।

জানা গেছে, উপজেলায় জলাশয়সহ সরকারি ও বেসরকারি ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার পুকুর। উন্মুক্ত জলাশয় ও নদ-নদীতে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ বিচরণ করতে পারে। কয়েক বছর যাবৎ এ জনপদে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এলাকার খাল-বিল, পুকুর ও নদী-নালাগুলোর অধিকাংশই পানিশূন্য। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ বৃষ্টির পানির তোড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ভেসে এসে বদ্ধ পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বংশ বিস্তার করে। পানির অভাবে এরা বর্ষা মৌসুমেও নদী-নালা খাল-বিলে বংশ বিস্তার করতে পারছে না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের মৎস্য জাদুঘর ও জীববৈচিত্র কেন্দ্রের দেশব্যাপী পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, হুমকির মুখে পড়া মাছের সংখ্যা এখন ১’শতে দাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে ২৫ প্রজাতির মাছ। ।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, কৃষি জমিতে অপরিমিত মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার দেশীয় প্রজাতির মাছের বর্তমান বিপর্যয়ের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিষের ছোবলে ডিএনএ এবং আরএনএর পরিবর্তন ঘটে। সেই সাথে ডিম ধারণ ক্ষমতা ৪০ ভাগ, ডিম নিষিক্তের হার ১৫ ভাগ এবং বাচ্চা প্রস্ফুটনের হার ২৫ ভাগ কমে যায়। এ ছাড়া অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নদী-নালা, খাল-বিল, গর্ত-ডোবা ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, ছাট বড় জলাশয় সেচে মাছ ধরা, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন ইত্যাদি।

রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক দশকে নদ-নদীগুলোর প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। নির্বিচারে খাল-বিল সেচে বা কীটনাশক ব্যবহার করে মাছ নিধনের ফলে মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে। এছাড়াও হ্যাচারিতে পানি সংকট দেখা দিলে খাল থেকে পানি সেচে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন খাল সেচে বা কীটনাশক ব্যবহার হওয়ায় তাও সম্ভব হয় না।

খাল-বিলে কীটনাশক ব্যবহার করায় দেশীয় মাছের প্রজনন ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া মাছ শিকারি নামের ছোট খাল-বিলে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে সব ধরনের ডিমওয়ালা মাছ মারা যাচ্ছে। এতে দেশীয় মাছের প্রজনন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এলাকা হয়ে পড়ছে দেশী মাছশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর অতিমাত্রায় বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এতে করে এ অঞ্চলে জলবায়ু এখন আর নাতিশীতোষ্ণ নেই। তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায় পৌঁছে গেছে। সমুদ্র-সৃষ্ট নি¤œচাপের পরিমাণ বেড়েই চলছে। প্রতিনিয়ত ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে। এ বৈরি আবহাওয়া ও অতিমাত্রার লবণাক্ততা দেশীয় প্রজাতির মাছ সইতে পারে না। ফলে ক্রমেই দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।





(বিডি/এস/এপ্রিল২২,২০১৬)