রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আজ সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পারকুমিরা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকসেনা ও রাজাকাররা মুক্তিকামী ৭৯জন লোককে গুলি করে ও ব্যায়নট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। সেদিনকার স্মৃতি আজো ভুলতে পারেনি এ এলাকার সকল শ্রেণির মানুষ। সরকারিভাবে এখানো সংরক্ষণ করা হয়নি এ গণকবরটি। নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ।

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে তালা উপজেলার পারকুমিরা গ্রামে গেলে তালঅ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলাম জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ফরিদপুর , পিরোজপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে বাণ্যিজিকশহর পাটকেলঘাটার পারকুমিরা ও পুটিয়াখালি গ্রামে অবস্থান নেয় দু’ শতাধিক মুক্তিকামী ও শরণার্থী নারী,পুরুষ ও শিশু।। ওই সালের ২৩ এপ্রিল শুক্রবার।

বাংলা সনের ৯ বৈশাখ। শরণার্থীদের উপস্থিতি টের পেয়ে সাতক্ষীরার দিক থেকে চার গাড়ি পাকসেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা ওই দিন দুপুরে পাটকেলঘাটা বলফিল্ডে এসে এলাপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। আতঙ্কিত মানুষজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোঁটাছুটি করতে থাকে। সেখান থেকে পাকসেনা ও রাজাকাররা পারকুমিরার চাউল ব্যবসায়ি গোষ্ট বিহারী কুণ্ডুর বাড়ি ঘেরাও করে। সেখানে অবস্থানকারি প্রায় ৫৫ জন ভারতে গমনেচ্ছু শরণার্থীকে ধরে নিয়ে আসে তারা। পরে গোষ্ট কুণ্ডুর বাড়িতে আগুণ লাগিয়ে দেয়। পরে জুম্মার নামাজ চলাকালে পুটিয়াখালি জামে মসজিদে ঢুকে তারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তার বাবা সরুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান, তার বড় ভাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা শরিফ হোসেন, শেখ ফজলুর রহমান, শেখ আজিজুর রহমান, শেখ আব্দুল মাজেদ, সালামত মল্লিকসহ ১২জনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে মনে করে দড়ি দিয়ে বেঁধে পার কুমিরা দাতব্য চিকিৎসলালয় (বর্তমানে সরুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স) মাঠে নিয়ে আসে। এরপর তারা পারকুমিরা দাতব্য চিকিৎসালয় কেন্দ্রে অবস্থানরত অনিল কুমার সরদার, গায়দার বিশ্বাসমহ ১২জনকে ধরে আনে। প্রথমে তারা আব্দুর রহমান ও শরিফ হোসেনকে এক দড়িতে বেঁধে রাইফেলের ব্যায়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। পরে আরো ৭৭জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় ১২জনকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। পাক হানাদারদের ভয়ে আতঙ্কিত স্থানীয় মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ উদ্ধার না করতে পারায় পরদিন কুকুরে ও শিয়ালে টানাটানি করতে থাকে। একপর্যায়ে ১৯ জনের লাশ কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেওয়া হয়। ইসহাক আলীর নেতৃত্বে বাকি ৪৯ টি লাশ গড়েরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (বর্তমানে পারকুমিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) পাশে নারায়ন পালের তাল গাছের নীচে একটি ডোবায় যেন তেন প্রকারে মাটি দিয়ে পুতে ফেলা হয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় প্রবীণরা নারকীয় সেই স্মৃতি আজো ভুলতে পারেনি।

১৯৯২ সালের ২৪ মে তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার কাশীপুরে এসেছিলেন। পারকুমিরার এ বিভর্ষতা জেনে তিনি সরুলিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাঠে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের লক্ষে একটি স্মৃতি ফলক উন্মোচন করেন। ২০০৯ সাল থেকে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও নতুন প্রজন্নের কাছে তুলে ধরার জন্য সংরক্ষণ করা হয়নি পারকুমিরা গণকবরটি। নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ।

পাকহানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদরদের বর্বরতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা নতুন প্রমন্মর কাছে তুলে ধরতে পারকুমিরা গণকবরটি সংরক্ষণ ও একটি স্মৃতিসৌধ নির্মানে সরকার খুব শ্রীঘ্রই উদ্যোগ নেবে বলে আশাবাদি স্থানীয়রা।

সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের ডেপুটি কমাণ্ডার, আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন,পারকুমিরায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যখন যুদ্ধ হয়েছিল তখন পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় মুক্তিকামি মানুষসহ ৬০/৭০জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে একটি গণকবর দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর গণকবরটি সংরক্ষণের জন্য দাবি করেছি। সরকারও সম্মত হয়েছিল। আগামিতে নতুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারে সেজন্য পারকুমিরায় একটি গণকবর ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতি সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। এজন্য জেলার সকল গণকবরগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণে এলজিইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।




(আরএনকে/এস/এপ্রিল২৩,২০১৬)