গোলাম কবির বিলু, পীরগঞ্জ (রংপুর) থেকে : কলেজের সিঁড়ি বেয়ে কোন রকম উপরে উঠলেও শারিরীক প্রতিবন্ধী আম্বিয়া আক্তার শোভার জীবনের সিঁড়ির কি হবে। আম্বিয়াতো নয়ই, কেউই বলতে পারে না। পরিবার, শিক্ষক, প্রতিবেশী সবাই শোভার অদম্য মেধার তারিফ করলেও অনিশ্চিত তার জীবন।

আম্বিয়া শারিরীক প্রতিবন্ধী কলেজ ছাত্রী। পা আছে, তবে না থাকার মতই, অচল। হাত দিয়েই চলাফেরা তার। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন বাবা আনিছার রহমান ও মা দুলালী বেগমের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় শোভা। সে উপজেলার খালাশপীর বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজে বিএ ২য় বর্ষের ছাত্রী। অদম্য এই মেধাবীর গানের কন্ঠও সুন্দর। হাত দিয়ে কলেজে চলাফেরা করে সে।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের খয়েরবাড়ী শ্যামপুর গ্রামে জন্ম হয় শোভার। বাবা আনিছার শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পিয়ন। জন্ম থেকেই শোভার বাম পা পঙ্গু। দিন যায়, বেড়ে উঠে সে। শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু। বাবার পিঠে চড়ে ক্লাস করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাশ করে শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিছুদিন বাবার পিঠে, তারপর দু’হাতের তলায় সেন্ডেল দিয়ে হেঁটে (হাত দিয়ে) স্কুলে যাতায়াত।

বাবার অভাবের সংসার। খাবার জোটানো আর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা চালানো কষ্টকর হলেও ধার-দেনায় একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন মেয়েকে। কিছুদিন হুইল চেয়ারে চেপে ক্লাস, তারপর ভেঙ্গে যায় সেটি। হাতে ভর করেই আবার হামাগুড়ি দিয়ে স্কুলে যায় সে। হাত দিয়ে চলাচলের কারণে মোটা হয়ে গেছে হাত দুটি। এভাবেই ২০১২ সালে জিপিএ- ৩.৩১ পেয়ে এসএসসি পাশ তার। স্কুলে পড়া অবস্থায় শোভা গানের চর্চা করে। স্কুলে টিফিনের ফাঁকে গান শুরু করলে শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হয়ে যায়। গানের কন্ঠ সুন্দর হওয়ায় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বরাবরই জয়ী হয়েছে। সহপাঠীদের সহানুভূতিশীল মনোভাব আর শিক্ষকদের আন্তরিকতায় পথ চলতে উৎসাহ পায় শোভা।

শুরু হয় কলেজ জীবন। বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে খালাশপীর বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ। তারপরও থেমে থাকেনি শোভা। ক্লাস করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় কলেজের উপর তলায়, আবার নামতে হয় তাকে। কিন্তু তার জীবনের সিঁড়ির কি হবে। এমন দোদুল্যমান প্রশ্নে ঘুরপাক খায় শোভা। ভ্যানে করে কলেজে, আবার একইভাবে বাড়ি। কলেজে ক্লাস পরীক্ষা ও উপস্থিতিতেও ভাল। ক্লাসের অবসরে গান গায় সে। প্রতিবন্ধী এই অদম্য মেধাবীর কন্ঠে অনানুষ্ঠানিক তালি দেয় কলেজের শিক্ষার্থী-শ্রোতারা।

শোভা জানায়- লেখাপড়া শিখে শিক্ষকতা করবো। সে আশা পুরণ হবে কিনা জানি না। পাশাপাশি শান্তনা পাওয়ার জন্য গান করি। সবাই উৎসাহ দেয়, উদ্দম পাই। দেশাত্মবোধক, জারি-সারি-মুর্শিদী গান গাইতে ভাল লাগে। তবে ক্লোজআপ ওয়ান তারকাদের গান আমাকে উৎসাহিত করে। সে আরও জানায়- যেদিন হাত দিয়ে বেশী হাঁটা হয়, সেদিন হাত দুটো খুবই ব্যথা করে। কিন্তু কি করবো। জনম দুখিনী মা (দুলালী বেগম) রাত জেগে হাত টিপে দেন। অসহায় পঙ্গুদের জন্য কষ্ট হয় শোভার। তাদের জন্য কিছু করতে চায় সে। তারা যেন সমাজের বোঝা না হয়। তার মা দুলালী বেগম জানায়- আমার মেয়েটার পড়ালেখার প্রতি দারুন ঝোঁক। কিন্তু ওর বাবা স্কুলের পিয়ন। আরও ৩ ছেলে লেখাপড়া করছে। খরচ যোগানো দায় হয়ে পড়েছে। বসতভিটে ছাড়া জমিজমা নেই।

কলেজ কিংবা বাড়িতে প্রায়ই ভরাট গলায় শোভা গেয়ে থাকে ‘এই মাটির বুকে লুকিয়ে আছে, লক্ষ মুক্তি সেনা, দেনা তোরা দেনা, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দেনা..., কিংবা তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, সহ আরও কত গান তার কন্ঠে শোনা যায়। একেবারে নিখাদ গলা তার। তার বাবা আনিছার রহমান বলেন- মেয়েটার পড়ার চেষ্টা আছে। কিন্তু অর্থাভাবে সংসারের ঘানি আর টানতে পারছি না। কিছু দিন আগে ডাঃ মোমিনুর রহমান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শোভাকে একটি হুইল চেয়ার দেয়া হয়েছে। ৩ ছেলের মধ্যে ১ জন কলেজে আর দু’জন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সাহায্য চাইতেও খারাপ লাগে। কিন্তু কি করবো! সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে আমার মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ হতো।

খালাশপীর বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ মোমিনুল ইসলাম বলেন- শারিরীক প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমরা তাকে কলেজের বিভিন্ন স্তরে সহায়তা করেছি। সে পড়ালেখায় ভাল।

(জিকেবি/এএস/এপ্রলি ৩০, ২০১৬)