সিরাজ প্রামাণিক : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহের রবীন্দ্র ‘কুঠিবাড়ি’ এদেশের মানুষের কাছে আলাদা স্থান দখল করে আছে। ফলে মহান এই কবির জীবনের বহু স্মৃতি জড়ানো শিলাইদহে ১৯৭২ সাল থেকে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠানের আয়োাজনের মাধ্যমে বিশ্বকবিকে স্মরণ করছে। প্রতিবছর কুষ্টিয়াবাসী কবির স্মরণে আয়োজন করছে রবীন্দ্র মেলার। তখন থেকে চলতে থাকা এ মেলা ৮/৯ বছর আগে থেকে আয়োজন করছে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন। ’

২৫,২৬ ও ২৭ বৈশাখ তিনদিন ধরে চলবে ‘রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী মেলা’। ২৫ বৈশাখ সকাল ১০ টায় কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সন্মেলন পরিষদের সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল আয়োজন। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের বক্তব্য ও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি কর্ম নিয়ে আলোচনায় অংশ নেবেন রবীন্দ্র গবেষকরা। এবারের মেলার শ্লোগান ‘অমৃত সন্ধানে চলো যাই’।

কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ কি.মি. দূরে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত সবুজ-শ্যামল ছায়া সুশীতল একটি গ্রাম। ঠাকুর পরিবারের এই বাড়িটি সবার কাছে শিলাইদহের কুঠিবাড়ী নামেই পরিচিত। পুরো বাড়ি আমবাগানে ঘেরা। বাড়ির চারপাশে ঢেউ খেলানো দেয়াল, যেন পদ্মারই ঢেউ। পাশে বকুল তলার শানবাঁধানো পুকুর ঘাট, জায়গাটা এখনো কোলাহলপূর্ণ। বাড়ির সামনে শান-বাঁধানো উন্মুক্ত বৈঠকখানা যেখানে প্রজারা এসে বসতো সেই সময়।

বাড়ির পেছনে টেনিস কোর্ট। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে বড় বড় কয়েকটি কক্ষ, সোফাসজ্জিত ড্রয়িংরুম। পড়ার টেবিল, চেয়ার, শোবার ঘর, বিছানো খাট, বড় আলমারী, বুকসেলফ, আরাম কেদারা, স্নানের চৌবাচ্চা, বিশালাকার কমোড বিশিষ্ট বাথরুম। জানালা খুললে উপনের দুই বিঘা জমি, সেই তাল গাছের স্থান। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক পর্যন্ত প্রশস্ত কাঠের ঝুলবারান্দা, সামনে চওড়া বারান্দায় আছে একটি বড় স্পিডবোর্ড, তিনতলার ছাদে উঠলে চোখে পড়ে পদ্মার চর, কখনোবা ঢেউয়ের খেলা। শুধু যা নেই তা হল কবির পদচারণা, কোলাহলমূখর সেইসব অতীত। পদ্মা-গড়াই-হিসনার শীতল স্রোতে প্লাবিত এই অঞ্চল। এখানকার জনপদের ইতিহাস এক নদীর মতোই উদার, মহান ও বিশালতাই পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছিলেন প্রথমে জমিদারী দেখাশোনা করার কাজে।

জমিদার রবীন্দ্রনাথ মিশে গিয়েছিলেন শিলাইদহের প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। তার প্রতিটি লেখায় মুর্ত হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের কথা। হয়তো শিলাইদহের অকৃত্রিমতাই মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়ে উঠেছিলেন আকাশ ভরা সূর্যতারা/ বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে, আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান...

শুধু জমিদারিত্বই নয় এই শিলাইদহ ছিল রবী ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অপূর্ব প্রেরণা। এখানে তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত এখানেই। এমনকি গীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় এই শিলাইদহে। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রীবন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন শিলাইদহে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে কখনও স্বল্প কখনও দীর্ঘ সময় থেকেছেন এখানে। এসেছেন একাকী কিংবা স্বপরিবারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোর্ডে, পালকিতে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহ কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তার লেখাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখানে সে সময় আবির্ভাব ঘটেছিল বড় বড় প্রভাবশালী মহৎ সব ব্যক্তিত্বের। তাই তিনি আবেগ ভরা কন্ঠে বলেছিলেন... ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি।

রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশাতে ১৩৪৬ সালের ১ চৈত্র শিলাইদহ পল্লী সাহিত্য সম্মেলনে সম্পাদককে লিখেছিলেন আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহের পল্লীতে। এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ সেই বাড়িটি এখন এক স্মৃতিচিহ্ন জাদুঘর। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে মানুষ পেতে পারে অতীতের সেই সোনালী স্পর্শ। এখানে আছে কবির আঁকা ছবি ও লেখা। এছাড়াও আছে কবি ব্যবহৃত পালকি, ছয় বেহারার পালকি, চার বেহারার পালকি। আছে ব্রিটিশ আমলের ঘাস কাটার যন্ত্র, কিছু দূর্লভ পেপার কাটিং ও কবির নিজ হাতে লেখা চিঠি। মূল বাড়ির বাইরে একটি বিশাল আকার মঞ্চ আছে।

প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্ত্রী (২৫ বৈশাখ) এখানে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। দেশ-বিদেশ থেকে রবীন্দ্র ভক্তরা যোগ দেয় এ অনুষ্ঠানে। ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে এখানে বসে তিন দিনের মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে লোক সমাগম হয় প্রচুর। সবর হয়ে ওঠে কুঠি বাড়ি। এবারে অনুষ্ঠানে মূল দাবী উঠেছে শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। মেলা উপলক্ষে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় তৈরী করেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্ররয় সিসিম বলেন, অতিথি ও রবীন্দ্র ভক্তরা যাতে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও গবেষক