আলী আখতার গোলাম কিবরিয়া : 'সভাপতি' ও 'সভানেত্রী' শব্দ দুটো নিয়ে আজকাল নিজে নিজে বিতর্কের মুখে পড়েছি। পুরুষের বেলায় সভাপতি আর মহিলা হলে সেক্ষেত্রে বলছি সভানেত্রী। ভালো কথা। তাহলে শেখ হাসিনা একজন মহিলা হয়ে আওয়ামীলীগের সভাপতি হলেন কীভাবে, সভানেত্রী হলেন না কেন? একথা বিশ্বাস করি, একটি দলের প্রধান সবসময় প্রাতিষ্ঠানিক পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি ওই দলের সকলের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন। সেই প্রতীক কখনই লিঙ্গ-লিঙ্গান্তর প্রশ্নে বিভাজিত হতে পারে না। বিভাজিত হলে অন্তত আমার কাছে সেটা খাপছাড়া লাগে।

সভাপতি বা সভানেত্রী না বলে 'সভাপ্রধান' বললে তো পুরুষ লিঙ্গ আর স্ত্রী লিঙ্গের এই ঝামেলাটি আমাদের পোহাতে হয় না। সভাপতিত্ব আর সভানেতৃত্ব শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তাও থাকে না। সরাসরি বলতে পারতাম 'সভানেতৃত্ব'। কারণ 'সভানেতৃত্ব' শব্দটি পুরুষ মহিলা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি'র 'চেয়ারপার্সন' আর এরশাদ সাহেব হচ্ছেন জাতীয় পার্টির 'চেয়ারম্যান'। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই বিতর্ক থেকে বাঁচতে মাতৃভাষা ছেড়ে তাঁরা সভাপতি বা সভানেত্রীর পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। আমার কাছে এটা মারাত্মক খাপছাড়া মনে হয়।

এবার অন্যদিকে চোখে ফেরাই। কবি তো কবিই। 'মহিলা কবি' কথাটি কেন? মহিলা কবি বললে 'মহিলা বিচারপতি' 'মহিলা প্রেসিডেন্ট' 'মহিলা প্রধানমন্ত্রী' 'মহিলা স্পিকার' বলছি না কেন? শিক্ষিকা, অধ্যক্ষা এসব কেন বলবো? অবশ্য বেশ কিছুদিন হলো ভুল শুধরে নিয়ে আমরা এখন ঠিকই শিক্ষক, অধ্যক্ষ ইত্যাদি বলতে শুরু করেছি। খাপছাড়ার আরও অনেক গল্প আছে। যেমন- আমরা আমাদের জাতীয় সংসদকে বলছি 'মহান সংসদ'। সংসদের আগে 'মহান' বিশেষণটি কেন যুক্ত করা হচ্ছে বুঝি না। এই সংসদকে ব্যবহার করে একসময় স্বৈরাচার তার গদি চালিয়েছে। এই সংসদে ইনডেমনিটি বিলসহ অনেক গণবিরোধী বিল পাস করে জনগণের ওপর দীর্ঘদিন জুলুম চালানো হয়েছে। সংসদের ভেতরে অশ্রাব্য-অশোভন আচরণ দেখতে দেখতে তো চোখে আজকাল জ্বালা ধরে গেছে। তাই বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করি, এ সংসদ 'মহান সংসদ' হয় কীভাবে? 'মহান সংসদ' কথাটি শুনতে বড়ই খাপছাড়া লাগে। শুধু সংসদ বললেই তো হয়। মহান সংসদ বলার কী দরকার!

সম্প্রতি মাছরাঙা টেলিভিশনে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন জিপিএ ৫ নিয়ে যে রিপোর্টটি করেছেন তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত প্রশংসার মনে হয়েছে। তিনি ওই রিপোর্টে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধা ধসের প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রক্রিয়াটি ভুল ছিল। তিনি সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে কাজটি করেননি। তিনি তাঁর সচিত্র প্রতিবেদনে দেশের গড়পরতা জরিপ উপস্থাপন করতে পারেননি, উপরন্তু শিশুদের ছবি প্রদর্শন করে তিনি ও মাছরাঙা টেলিভিশন মানবাধিকার ক্ষুন্ন করার মত বড় ধরণের অপরাধ করে ফেলেছেন। হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। এটি ছিল এক ধরণের অনৈতিক ও খাপছাড়া রিপোর্ট। যা হোক অনেক কথা হলো, সবশেষে 'খাপছাড়া' শব্দটি নিয়ে ভাষাবিশেষজ্ঞ ফরহাদ খানের সূত্রে এখন কিছু কথা বলে আপাতত বিদায় নিইঃ

'খাপছাড়া' শব্দটির অর্থ মিলশূন্য, বেমানান, অসংলগ্ন, অদ্ভুত, উদ্ভট ইত্যাদি। খাপ শব্দের অর্থ আবরণ। খাপছাড়া শব্দের অর্থ তাই দাঁড়ায় খাপ ব্যতিরেকে, অর্থাৎ আবরণহীন। অনেক জিনিস আছে যেগুলো আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় কিংবা আবরণের মধ্যে আড়াল করে রাখতে হয়, আবরণের বাইরে প্রকাশ্য হলে সেগুলো বিসদৃশ লাগে। কথার আবরণ হলো যুক্তি। যুক্তির বাইরে চলে গেলে কথার কোন মূল্য থাকে না। কথা হয়ে যায় খাপছাড়া।

কাজের মধ্যেও কার্যকারণ সম্পর্ক ও পরম্পরা রাখতে হয়। এই সম্পর্ক ও পরম্পরা হলো কাজের আবরণ। কাজের মধ্যে যদি এগুলো না থাকে সেসব কাজকে মানুষ খাপছাড়া বলবেই। আচরণ যদি মূল্যবোধহীন হয়, স্বাভাবিকতার বাইরে চলে যায়, তাহলে সে আচরণ অবশ্যই খাপছাড়া মনে হবে। খাপ থেকে খাপ খাওয়া বা খাপ খাওয়ানো বলে একটি অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক বাক্যভঙ্গিও আমাদের মাতৃভাষায় তৈরি হয়েছে। 'আমাকে আপনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে।' একথার অর্থ হলো আপনার ব্যক্তিত্বের মাপের সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।

লেখক : শিক্ষিক ও সাংবাদিক