স্টাফ রিপোর্টার : ব্রেন টিউমার নিয়ে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। ব্রেন বা মস্তিষ্কের টিউমার বা ক্যান্সারের উৎপত্তি প্রধানত দুটি উৎস থেকে।

একটি হলো অন্য কলা বা কোষ থেকে উৎপন্ন ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, যা মস্তিষ্কে রক্ত সংবহন, লসিকাগ্রন্থি যেমন সিএসএফের সাহায্যে মেটাসটেসিস বা দ্বৈতীয় হিসেবে আসে। দ্বিতীয়টি মস্তিষ্ক বা ব্রেনের প্রাইমারি বা মস্তিষ্কের কোষ কলা থেকে প্রত্যক্ষভাবে তৈরি প্রাথমিক টিউমার। বেন টিউমার দুই রকমের।

একটি হলো নির্দোষ বা বিনাইন টিউমার। এটি শরীরে থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হয়না। কেননা, এটি দেহের এক জায়গায় স্বাভাবিক কোষের মতো বিভাজিত হয়। চারদিকে ছড়ায় না এবং এদের বৃদ্ধিও ধীরে। দ্বিতীয় রকমের টিউমারটি হলো দোষী বা ম্যালিগন্যান্ট, যাকে ক্যান্সার বলা হয়। এটি স্বাভাবিক কোষের চেয়ে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দেহের সর্বত্র কাল সাপের থাবার ন্যায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আজ ৮ জুন, বিশ্ব ব্রেন টিউমার দিবস। ব্রেন টিউমারের মতো একটি মারাত্মক রোগ সম্পর্কে মানুষদের সচেতন করার লক্ষ্যে ২০০০ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীর প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত।

বিশেষ এ দিবসটি পালনের উদ্যোগ হিসেবে ১৯৯৮ সালে গঠন করা জার্মান ব্রেন টিউমার অ্যাসোসিয়েশন। এটি একটি অলাভজনক দাতব্য সংস্থা যারা ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীদের প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে চিকিৎসেবা শুরু করে।

গবেষণায় জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৪০,০০০ আমেরিকান ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়। এদের অর্ধেক হলো প্রাইমারি আর বাকিরা সেকেন্ডারি বা মেটাস্ট্যাটিক বা দ্রুত বর্ধনশীল টিউমার। যেকোনো বয়সের যে কোনো ব্যক্তি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হতে পারে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ছয় থেকে নয় বছর বয়সীদের মধ্যে এই মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক। তথাপি ব্রেন টিউমার হচ্ছে মাঝবয়সী ও বৃদ্ধদের মধ্যে একটি সাধারণ রোগ। ষাট বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই ভয় আশঙ্কাজনক এবং প্রতি বছর পাঁচ হাজার জনে একজন এই বয়সের লোক ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়।

মস্তিষ্কের ক্যানসার দমনে ভাইরাস ক্যানসার রোগটির নাম শুনলেই সবাই আঁতকে ওঠেন। মস্তিষ্কের ক্যানসার হলে সাধারণত প্রচলিত পদ্ধতিতেই চিকিৎসা দেয়া হয়, যেমন - অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে। এটা নির্ভর করে ব্রেনের কোন জায়গায় টিউমারটি হয়েছে তার ওপর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী মৃত্যু এড়াতে পারেন না। সম্প্রতি ব্রেইন টিউমারের ক্ষেত্রে নতুন এক পদ্ধতি চিকিৎসা জগতে আশার আলো জাগিয়েছে আর তা হলো, এক ধরনের ভাইরাসের মাধ্যমে এ টিউমারকে দমন করা ভাইরাসটির নাম পারভোভাইরাস। ক্যানসার গবেষক জঁ রোমলেয়ার ও নিউরো শৈল্যচিকিৎসক কার্সটেন গেলেটনেকি বহু বছর ধরে এ ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করছেন। এ ভাইরাস মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়, কিন্তু ক্যানসারের কোষকে ধ্বংস করতে পারে। গবেষণাগারে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রাণীদেহে সাফল্য গবেষকরা এখন জানতে আগ্রহী। পারভোভাইরাস কি ব্রেইন টিউমারের সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে পারবে? এ পরীক্ষার জন্য তারা মানুষের টিউমারের জিন কয়েকটি ইঁদুরে ঢুকিয়ে তারপর পারভোভাইরাসের ইনজেকশন দেন। প্রথমে মারাত্মক টিউমারটি দ্রুত বাড়তে থাকে। কিন্তু পরে বিরাট এক বিস্ময় দেখা দেয়। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির নিউরো শৈল্যচিকিৎসক কার্সটেন গেলেটনেকি বলেন, ‘আমার সঙ্গে রেডিওলজিস্ট এক সহকর্মীও ছিলেন। তিনি প্রথমে বলেছিলেন এটা একটা যান্ত্রিক ভুল, সত্যি সত্যি এটা হতে পারে না। আমিও এ পরীক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না, কেননা ফলাফলটা অভিভূত করার মতো ছিল। এরপর আমরা ঠিক করলাম আরো দুদিন অপেক্ষা করে দেখা যাক। টিউমারটি আরো ছোট হতে লাগল।’

এ পরীক্ষায় ১২টির মধ্যে আটটি ইঁদুরের টিউমার একেবারে চলে গিয়েছিল এবং পরেও আর দেখা দেয়নি। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারভোভাইরাসকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এখন সব রোগী পারভোভাইরাস সহ্য করতে পারলে গবেষকরা প্রথমে কয়েক রোগীকে এ ভাইরাসের ডোজ বাড়িয়ে চিকিৎসা করবেন। তাদের আশা, ইঁদুরের মস্তিষ্কের মতোই প্রথমে ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পরে ক্যানসারের কোষ ধ্বংস হবে। এতে মস্তিষ্কের টিউমার একেবারে দূর হবে এবং এ ধরনের ক্যানসারের হাত থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারবে।

এ দুই বিজ্ঞানী চার বছরের মধ্যে বলতে পারবেন এ চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষের ক্যানসার দমনেও কাজে লাগবে কি না। তবে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভাইরাস যে একটা ভূমিকা নিতে পারবে, এ ব্যাপারে আশাবাদী তারা।

ব্রেন টিউমারের লক্ষণ
যে কোনো ব্রেন টিউমার বা ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ হলো মাথাব্যথা। এটা সাধারণত মস্তিষ্কের মধ্যে প্রেসার বাড়ার কারণে হয়ে থাকে, যাকে বেশি ইন্ট্রাক্রানিয়াল প্রেসার বলে। ব্রেনের টিউমার বা ক্যান্সারের আরেকটি প্রধান লক্ষণ হলো খিঁচুনি হওয়া। এ খিঁঁচুনি শরীরজুড়ে বা জেনারালাইজড অথবা স্থানীয় কোনো অঙ্গে বা লোকালাইজড হিসেবে প্রকাশ পায়। খিঁচুনির সঙ্গে ব্রেনের কোন জায়গায় টিউমার বা ক্যান্সার হয়েছে, তার লক্ষণ প্রকাশ পাবে। যেমন ব্রেনের ফ্রন্টাল লোব বা সামনের অংশে টিউমার বা ক্যান্সার হলে ব্যক্তিগত, সামাজিক আচরণগত পরিবর্তন, প্যারাইটাল লোবে টিউমার বা ক্যান্সার হলে কথাজড়তা, হিসাবে গরমিল; টেমপোরাল লোবে ক্যান্সার বা টিউমার হলে কানে সমস্যা, গন্ধের সমস্যা, পেছনের দিকে বা অক্সিপিটাল লোবে টিউমার বা ক্যান্সার হলে দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা হবে।

রোগ নির্ণয় : যত শিগগির সম্ভব নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়ে নিচের রোগ নির্ণয়ক পরীক্ষাগুলো করাতে হবে-

-স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখার জন্য ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি বা ইইজি।
-স্নায়ুতন্ত্রের পরিবহন ক্ষমতা বা নার্ভ কন্ডাকশান টেস্ট বা ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি।
-রেডিওলোজি বা ইমেজিং যেমন ব্রেনের সিটিস্ক্যান এবং এমআরআই যে কোনো ধরনের ব্রেনের রোগ নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট।
সিটি গাইডেড এফএনএসি : যে কোনো টিউমার বা ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ে অত্যন্ত নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা। এর সুবিধা হলো, রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না এবং একের অধিকবার এ টেস্ট করা যাবে।

যদিও ব্রেন টিউমার বা ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেরিতে প্রকাশ পায় তথাপি যে কোনো ধরনের বেশি ইন্ট্রাক্রানিয়াল প্রেসারের লক্ষণ যেমন মাথাব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, খিঁচুনি, ফোকাল ডিফেক্ট, কথা বলায় জড়তা, হিসাব গরমিল, স্ট্রোক এক বা দু'দিকে অবশ হওয়া, গন্ধ শনাক্ত সমস্যা ইত্যাদি হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

ব্রেন টিউমার থেকে বাঁচতে সচল রাখুন আপনার মস্তিষ্ককে। মস্তিষ্কের শক্তি কীভাবে বাড়াবেন তা নিয়ে কিছু টিপস জেনে নিন-
- হঠাৎ উত্তেজিত হবেন না।
- পরিস্থিতি মূল্যায়নে যথেষ্ট সময় নিন। প্রয়োজনে সমমনাদের সঙ্গে আলাপ করুন।
- সবকিছু যুক্তি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করুন,
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন,
- ঘুমানোর সময় সোজা হয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করুন, - প্রচুর পানি পান করুন,
- সব সময় হাসিখুশি থাকুন,
- কাজের ভেতর থাকতে চেষ্টা করুন,
- পরিমিত ঘুমাতে চেষ্টা করুন,
- অবসরে কম সাউন্ডে খানিকটা সংগীত উপভোগ করুন,
- কোনো কিছু নিয়ে বেশি ভাববেন না,
- দ্রুত পড়ার অভ্যাস করুন,
- প্রিয়জনের নাম মনে করার চেষ্টা করুন,
- প্রকৃতি নিয়ে ভাবুন, বন্ধুদের সহায়তার চেষ্টা করুন,
- সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করুন
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

(ওএস/এটিআর/জুন ০৮, ২০১৪)