রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি : ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। এ প্রবাদ বাক্যটি নিজের জীবনে যেমন বাস্তবায়ন করেছে তেমনি অন্যের জীবনের ভাগ্যের চাকাও বদলানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরবংশী গ্রামের সফল মেয়ে আয়েশা। সে মৃত আব্দুল হালিমের মেয়ে।

অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা। সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা নির্বাচিত হয়েছেন। তার সফলতায় নকশীতে লক্ষ্মীপুর জেলা এখন দেশের অন্যতম ব্যান্ডিং। শুধু ব্যান্ডিংই নয় সাথে তিনি সৃষ্টি করেছেন ৫শ’ নারী তাদের নিজের কর্মসংস্থান। সমাজের বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও এলাকার দরিদ্র নারীদের নিয়ে নিজ বাড়িতে শুরু করেন ছোট্ট একটি বুটিক কারখানা।

বর্তমানে রায়পুর উপজেলার চরবংশী এলাকার বিভিন্ন বাড়ি, চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার কাটাখালী ও সদর উপজেলার কামান খোলা এলাকার বাবুর বাড়িতে মিলে রয়েছে শতাধিক বুটিক ফ্রেম। এসকল ফ্রেম ভাড়া ঘরে ৩শ’ নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বুটিক কারখানা। নিজ গ্রামেও এই কাজের সাথে জড়িত রয়েছে আরো প্রায় ২শ’ নারী। এসব নারী সদস্যদের হাতে কাজ করা বুটিক শাড়ী যাচ্ছে ঢাকা শহরের বসুন্ধরা মার্কেট, নিউ-মার্কেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কামানখোলার বাবুর বাড়িতে ঘিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে চলছে শাড়ীতে বুটিকের কাজ। সমাজের পিছিয়ে পড়া মহিলারা ও লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা শাড়ীতে বুটিকের কাজ করে বাড়তি টাকা রোজগার করছে। আয়েশার নিজের এই উদ্যোগে ৫শতাধিক মহিলা সাবলম্বী হতে চলছে।

কথা হয় ঐ কারখানার সুপারভাইজার রোজিনার সাথে। তিনি জানান, গ্রামীন জনপদ ও ঘরোয়া পরিবেশে এসব মহিলারা শাড়ী বুনিয়ে সাবলম্বী হতে চলছে। একটি শাড়ীতে বুটিকের কাজ করতে ৫ জন মহিলা দরকার হয়। কাজ শেষ করতে তাদের এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। একটি শাড়ী বুনতে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা । বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। তবে বর্তমান বাজারে মেনট্রেসের দাম বৃদ্ধি পাওয়া আগের তুলনায় লাভ কম হচ্ছে। এখানকার কাজ করা এসব শাড়ী ঢাকা শহরের বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী করে দরিদ্র নারীদের অন্ন যোগানোর পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

দুপুর গড়িয়ে ঠিক সাড়ে ৩টা বাজে। পরিচয় মিলে বুটিক কারখানার মূল উদ্যোক্তা আয়েশা বেগমের সাথে। তার সাথে আলাপকালে তিনি তুলে ধরেন তার জীবন কাহীনি।

আয়েশা বলেন, ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের আব্দুল হালিমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। দরিদ্র দিনমজুর পরিবারে জন্ম নেয়া আয়েশা ৭ বোনের মধ্যে প্রথম। অভাবের সংসারে একের পর এক বোন হলে বাবা মা তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে ঠিক তখনই তার বিয়ে হয়ে যায় একই এলাকার কৃষক মোস্তফার সাথে। বিয়ের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের ৪ বছরের মাথায় তাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।

এতে আয়েশা আরো চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিজের শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও শিক্ষিত হতে না পেরে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্ন বুনেন। কিন্তু দিনমজুরী স্বামীর উপার্জন দিয়ে সংসার ও ছেলে লেখাপড়া চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য সে নিজেই এলাকার একটি বুটিকের দোকানে মাসে ১৫’শ টাকা বেতনে চাকরি নেয়। এর মাঝে আয়েশা তার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরনের জন্য ‘বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশবিদ্যালয়ের’ মাধ্যমিক শাখার ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।

এর মাঝে কিছু কাজ শেখা হলো আয়েশার। পরে প্রতিবেশিদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে আয়েশা নিজের ঘরেই একটি ছোট বুটিকের কারখানা গড়ে তুলেন। এ আয় দিয়ে ছেলের লেখাপড়া ও সংসার চলতে শুরু হয়। এতেই সংসারের কিছুটা অভাব দূর হয়। এভাবেই ৬ বছর পার হলে আয়েশা ‘বাংলাদেশ উম্মক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে বিএ পাসও করেন। পরে সমাজের বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও এলাকার দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য নিজের ছোট বুটিকের আয় দিয়ে ১৩টি ফ্রেম দিয়ে গ্রামে গড়ে তুলেন একটি বড় কারখানা। ঘুরে যায় তার জীবনের গতি।

ভাবতে থাকে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের কথা। পরে এসব নারীসহ আশ-পাশের গ্রামের সমাজের বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও এলাকার দরিদ্র নারীদের নিয়ে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার কাটাখালী এবং চলতি বছরের ১ জুলাই সদর উপজেলার কামানখোলা এলাকার বাবুর বাড়িতে তিনটি কারখানা গড়ে তোলেন। যার মধ্যে শতাধিক ফ্রেমে কাজ করছে ৩ শতাধিক নারী এবং চরবংশী নিজ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে এই বুটিকের কাজ করে সাবলম্বী হচ্ছে আরো ২শ’ নারী। আয়েশা ২০১৪ সালে জেলায় শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা নির্বাচিত হন। ওই বছরই চট্টগ্রাম বিভাগে ৫০টি উপজেলার ২৫০ নারীকে পিছনে ফেলে অর্থনীতিতে সাফল্য জনক ভুমিকার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা লাভ করে আয়েশা নির্বাচিত হন শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে।

আয়েশা বলেন, আমার এই সম্মাননা সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য উৎসর্গ করেছি। তবে আমার বুটিক কারখানায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নারীর কর্মসংস্থান করাসহ উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পেত। শিল্প কেন্দ্রীক সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহনে ভাগ্য বদল হতে পারে এ অঞ্চলের সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের। সরকারি বা কোন দাতা সংস্থার সহযোগিতা পেলে এ পেশায় আরো বহু নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

(পিকেআর/এএস/জুন ২৭, ২০১৬)