মির্জা মোঃ আজিম হায়দার /ইন্দ্রজিত দাস

ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস:ভূ-গর্ভের অভ্যন্তরে যে স্থানে পানি পাওয়া যায় তাহাই ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস। দীর্ঘকাল যাবৎ ভূ-গর্ভস্থ পানিকে আমরা নিরাপদ পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এসেছি। কিন্তু ইদানিং অনেক ক্ষেত্রে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানিকেও বিনা পরীক্ষায় নিরাপদ পানি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

(আমরা জানি শারীরিকভাবে দুর্বল, পুষ্টিহীন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, তারাই দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে আর্সেনিক-আক্রান্ত হয়, সেই হিসেবে আমাদের সমাজে নারীরাই বেশি দুর্বল ও পুষ্টিহীন হবার কারণে তারাই আর্সেনিকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, আর্সেনিক-আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি।

পানি অধিকারের তথ্যচিত্রঃ
• পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। এসব মানুষ নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন সব চাহিদা মেটাতে একজন মানুষের ২০ থেকে ৪০ লিটার পানি প্রয়োজন। র্জামানিতে জনপ্রতি পানির খরচ দিনে ১৩০ লিটার এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ লিটার।
• জাতিসংঘের তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রতি আট জন মানুষের মধ্যে একজন বিশুদ্ধ খাবার পানি পান না। বর্তমানে বিশ্বের ৮৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত।
• প্রতি বছর ৩৫ লাখ মানুষ পানি বাহিত রোগে মারা যায়। ২০২০ সাল বিশ্বে ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ পানিবাহিত রোগে মারা যাবে।
• ক্স পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধার অভাবে বিভিন্ন রোগে ভুগে প্রতি বছর ১৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। যাদের বয়স ৫ বছর বা তার কম।
• ক্স ধারণা করা হচ্ছে ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পানি সংকটে ভুগবে।
নারীর পানি সংগ্রহ ও বহনের তথ্যচিত্র
• বিশ্বের ১.২ বিলিয়ন দরিদ্র মানুষের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ নারী পানি সংকটে জীবন যাপন করে। উৎপাদনশীল ও গৃহস্থালী কাজে নিরাপদ পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়।
• পানি সংকট নারীদের জন্য অধিক র্দুদশা বয়ে আনে পুরুষের চেয়ে। পৃথিবীর লাখ লাখ নারীকে নিরাপদ পানির জন্য বহুদূর ছুটতে হয় প্রতিদিন।
• আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নারী ও কিশোরীদের পানি সংগ্রহের জন্য দিনে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পথ খালি পায়ে হাঁটতে হয়।
• আফ্রিকার প্রতি ১০ জনে ১ জন কিশোরী তাদের বয়ঃসন্ধিকালে স্কুলে পরিুছন্ন এবং নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা না থাকায় স্কুল ছেড়ে দেয়।
• বেনিনের গ্রামাঞ্চলে ৬-১৪ বয়সের মেয়েদের দিনে গড়ে ১ ঘণ্টা পানি সংগ্রহে সময় ব্যয় করতে হয়। তাদের ভাইদের ব্যয় করতে হয় ২৫ মিনিট।
• মালেতে ঋতুভেদে পানি সংগ্রহের জন্য সময় ব্যয় করার ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু নারীদের অনবরত এ কাজে পুরুষের তুলনায় ৪ থেকে ৫ বার সময় ব্যয় করতে হয়।
• তাঞ্জানিয়ার এক জরীপে দেখা গেছে, মেয়েদের মধ্যে যাদের বাড়ি পানি উৎস থেকে ১ ঘণ্টা বা তারও বেশি দূরুত্বে তাদের তুলনায় যাদের বাড়ি পানি উৎস থেকে ১৫ মিনিটের দূরুত্বে তাদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ১২% বেশি।
• তাঞ্জানিয়ার ১২% বাড়ির শিশুরা পানি সংগ্রহ ও বহনের মূল দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে ১৫ বছরের নিচের মেয়েরে ঐ বয়সী ছেলেদের তুলনায় ২ বার পানি বহন করে।
• আফ্রিকার খরা অঞ্চলের এক জরীপে বলা হয়েছে- নিম্ন আয়ের দেশগুলোর নারীর ও শিশুরা পানি সংগ্রহ ও বহনে বছরে ৪০ বিলিয়ন ঘণ্টা ব্যয় করে যা ফ্রান্সের ১ বছরের সামগ্রিক শ্রমশক্তির সমান।
• ২০০৪ সালের কনজ্যুমার ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টে বলা হয়েছে উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র নারীরা দিনে ৮ঘণ্টা সময় ব্যয় করে পানি বহনে। প্রায় ২০ কেজি ওজনের পানি তাদের মাথায় করে বহন করতে হয়।
• যুক্তরাষ্ট্রের একজর নারীর তুলনায় কেনিয়ার বস্তির একজন নারীকে সমপরিমাণ নিরাপদ পানির জন্য পাঁচগুন বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
• মৌসুম ও অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের নারীদের পানি সংগ্রহের জন্য দিনের প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। ওয়াটার এইড’এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারের জন্য শুধু পানি সংগ্রহ করতে আমাদের দেশে সমগ্র নারীদের প্রতিদিন ২০ কোটি ঘণ্টা সময় খরচ হয়। (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ৮ মার্চ ২০১১)।
• পানি বহন একটি সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর কাজ। এই কাজটি সব সময় পরিবারে নারীর কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে পয়ঃনিষ্কাশন কাজে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের দায়িত্ব নারীদের ওপরই বর্তায়। এটা তাদের কর্ম, শিক্ষা, বিশ্রাম ও বিনোদন সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
• নারীর জীবনের মূল্যবান শ্রমঘণ্টা নিঃশেষিত হয় পানি ব্যবস্থাপনার মতো পরিবারের অপরিহার্য কাজটি করে। এই কাজে আত্মর্নিভরশীলতা বা পরিবারের আয়বর্ধক কিছু না হওয়ায় এ শ্রমের কোনো মূল্য পায় না নারী।
• পানি ব্যবস্থাপনায় নারীর অবদানকে কখনো স্বীকার করা হয় না। এমনকি পরিবারে মৌখিকভাবে নারীর এ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করা হয় না।
• নারীর জন্য পানি বহন স্বাস্থ্যহানিকর কাজ। পানি বহনের ফলে রক্তস্বল্পতার সাথে নারীর জরায়ুর স্থানচ্যুতি ঘটার মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা যোগ হয়। অনেক সময় পিছলে পড়া, প্যারালাইসিস হওয়া, পিছনের হাড় ভেঙে যাওয়া এবং অকাল গর্ভপাতের মতো ঘটনা পানি বহনের সময় ঘটে থাকে।
• নারীর জীবনের নিয়মিত প্র্কাৃতিক ঘটনা ঋতুস্রাবের সাথে পরিষ্কার-পরিুছন্নতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যার জন্য পর্যাপ্ত জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু যখনই জীবাণুমুক্ত পানির সংকট দেখা দেয়, তখন নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের সুস্থতা বিঘিœত হয়।
• সারাদিনের গৃহস্থালি কাজের প্রয়োজনীয় পানির যোগান ও ব্যবহার যেহেতু নারীকেই করতে হয়। তাই যেকোনো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নারীরই বেশি থাকে।
• আর্সেনিক-আক্রান্ত নারীদের তৈরি করা খাবার কেউ খেতে চান না। আর্সেনিক-আক্রান্ত অবিবাহিত নারীদের সাথে কেউ সাধারণত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। এ সমস্যায় আক্রান্ত বিবাহিত নারীদের অনেক সময় তালাক পর্যন্ত হয়ে যায়।
• নিরাপদ পানি পাওয়া যে মানুষের মৌলিক অধিকার, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য থেকে নারী বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় পানির উৎস, পানি ব্যবস্থাপনা, আর্সেনিক প্রভৃতি বিষয়ক তথ্য থেকেও। আর সঠিক তথ্য ও জ্ঞান না থাকায় নারীর দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়।
• পানি সংগ্রহের জন্য আসা-যাওয়ার পথে বখাটে লোকজন নারীদের উত্ত্যক্ত করে। এর ফলে কখনো কখনো নারীর শারীরিক নিরাপত্তাও বিঘিœত হয়।
• স্কুল থেকে মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়, এটা দুভাবে হতে পারে-
১. পানি সংগ্রহের জন্য একজন কিশোরীকে অনেকটা সময় দিতে হয় বলে সে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে;
২. স্কুলে পানি বা বাথরুম, টিউবওয়েল না থাকার কারণে নানা জটিলতায় পড়ে স্কুলের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। আর এক পর্যায়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
সবশেষে গৃহস্থালি কাজে নারীর সম্পৃক্ততাকে কেবলই নারীর কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে পরিবারে নারীর শ্রমশোষণের যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে ক্রিয়াশীল, তার পরিবর্তন দরকার।
পরিবারের পানিসংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের কাজ যুক্ত থাকার পরও সে পানি সংগ্রহের জন্য মূলত নারীকেই ভূমিকা রাখতে হয়। নারী তার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামটুকুও নিতে পারেন না। বিষয়টা অনেক সময় অমানবিক হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের যতনবান হওয়া উচিত এবং পরিবারের সকল সদস্যরেই এসব কাজ ভাগ করে নিয়ে সম্পাদন করা উচিত।






(অাইডি/এস/জুন২৮,২০১৬)