প্রবীর সিকদার


আজ কেন যেন খুব মনে পড়ছে আলী কাকার কথা। বটগাছের চেয়েও বড় আমার সেই আলী কাকা। বাবার খুব প্রিয় ছাত্র আব্দুল আলী মোল্লাই আমাদের প্রিয় আলী কাকা। বাবার অনুপ্রেরনায় আলী কাকা ফরিদপুরের কানাইপুরে আওয়ামীলীগের গোড়াপত্তন ঘটান। সেই সময়টি বড় উত্তাল ছিল। আলী কাকা আওয়ামীলীগের ঝাণ্ডা খুব শক্ত করেই সবার ওপরে তুলে ধরেছিলেন।

আওয়ামীলীগই হয়ে উঠেছিল তার ঘর-বাড়ি-ধ্যান। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নৌকার পালে হাওয়া লাগিয়ে একাত্তরে যুদ্ধে চলে যান আলী কাকা। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ নিয়ে যখন ফিরলেন, তখন তার প্রিয় পরেশ স্যার অর্থাৎ আমার বাবা আর নেই। শুধু কি আমার বাবা! মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যান আমার দুই কাকা, দাদু, মামাসহ অনেক স্বজন। ঘর হারা, সম্পদ হারা, স্বজন হারা আমাদের পাশে বটগাছের মতো দাঁড়ালেন আলী কাকা ; সেই সব স্মৃতি যখন ভেতরে নড়েচড়ে ওঠে, তখন মনে হয়, আমার সেই আলী কাকা তো বটগাছের চেয়েও অনেক অনেক বড় ছিলেন। খাবার চাল আলী কাকা, ইস্কুলের বই আলী কাকা, প্যান্ট শার্ট আলী কাকা, জুতা ছিঁড়ে গেলে আলী কাকা, ফুটবল চাই আলী কাকা, ফি না দেওয়ায় কিবরিয়া স্যার পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিলেই আলী কাকা ......... আলী কাকা ছিলেন না কোথায়! আমাদের সেই শৈশবে আলী কাকা আমাদের সব হারানোর ব্যথা একা বহন করেছেন; আমরা কিছু বুঝতেই পারিনি একাত্তরের স্বজন হারানোসহ সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা। মানুষ কী এতো ভালো হয় কখনো ! একাত্তরের সব হারানোর যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম পঁচাত্তরে, যেদিন জাসদের গণবাহিনী আমার সেই বটগাছের চেয়ে বড় আলী কাকাকে খুন করলো। তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। সমাজ-রাষ্ট্রের নানা কারসাজিতে আমরা আর মনে রাখতে পারিনি আলী কাকাকে! এতো কাছের মানুষ, কতো দূরে ঠেলে দিয়েছি অবলীলায়! অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানটাই হয়ে উঠেছিল অস্তিত্ব কিংবা সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার একমাত্র উপকরণ ; সেখানে তো আর আলী কাকা ছিলেন না। এভাবেই বুঝি মানুষ হয়ে ওঠে অমানুষ; ভুলে যায় দুর্দিনের সেই মানুষ কিংবা মহামানবকে!

আলী কাকা, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও ; নপুংশক হয়ে কোনো মতে বেঁচে আছি ; আমি বা আমরা তোমার যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারিনি। অবশ্য এই জীবনে সেই আশাও করি না ; সত্যটা হচ্ছে বটগাছ নেই, নেই তার ছায়াও। এখন দূর্বা ঘাসেই খুঁজি ছায়া!

(পিএস/অ/জুন ৩০, ২০১৬)