সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। দোকানে দোকানে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভিড়। তাই শপিং ব্যাগের চাহিদাও বেড়েছে। চাহিদা মেটাতে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মাঝিয়াড়া গ্রামের দেবনীলা এন্টারপ্রাইজের শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

সরজেমিনে শুক্রবার সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মাঝিয়াড়া গ্রামে গেলে দেখা গেছে দেবনীলা এন্টারপ্রাইজের শ্রমিকরা শপিং ব্যাগ তৈরিকে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ বা থান কাপড় ভাজ করছেন, আবার কেউ বা সেলাই করছেন। আবার কেউ ব্যাগের দু’পাশে মেশিনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছাপ লাগাচ্ছেন। অনেকেই বাড়িতে কাজ করার জন্য সিট কাপড় ও সূতা নিয়ে যাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

পরিচয় জানতেই ম্যাশিনে সিট কাপড় কাটতে থাকা এক মাঝ বয়সী যুবক নিজেকে দেবনীলা এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী উল্লেখ করে বলেন, এক সময় তিনি জমিতে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

১৯৯৬ সালে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানায় বেড়াতে যেয়ে অস্কার ও পায়েল নামের দু’টি শপিং ব্যাগ কারখানা ঘুরে দেখার সূযোগ পান। দেখে ভাল লাগায় দেশে ফিরে কারাখানা গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এরপর কয়েকবার লুধিয়ানায় বেড়াতে যেয়ে ব্যাগ তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করেন। ২০০৯ সালের পহেলা বৈশাখে দু’টি বেসরকারি সংস্থা জাগরণী চক্র ও আশা থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নিজের পাঁচ শতক জমিতে চার জন শ্রমিককে নিয়ে গড়ে তোলেন দেবলীনা এন্টারপ্রাইজ নামের শপিং ব্যাগ কারখানা। ব্যাগ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় থান কাপড় (নন ওভেন ফেব্রিকস) ও প্লাস্টিক সূতা চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে আনা হয়। উৎপাদিত ব্যাগ সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চল, খুলনা, যশোর, পিরোজপুরসহ আটটি জেলায় বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এ কারাখানায় ৪০ থেকে ৪৫ জন শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে। যাদের অধিকাংশই নারী।

গৃহিনী থেকে কলেজ ছাত্রীরাও তাদের সাংসারিক কাজ ও পড়াশুনার ফাঁকে ব্যাগ সেলাই করে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা উপার্জন করে থাকেন।

এখানে সাত প্রকার ব্যাগ তৈরি করা হয়। একটি থান ৩২ ইঞ্চি থেকে ৭২ ইঞ্চি চওড়া ও ২০০ থেকে ৫০০ গজ লম্বা হয়ে থাকে। কাপড়ের মান ৪০,৫০, ৭০, ৮০ ও ৯০ গেজের হয়ে থাকে। সাধারণতঃ ৪০ ও ৫০ ও ৫০ গেজের কাপড় দিয়ে ফ্লাড ব্যাগ তৈরি করা হয়। ৭০. ৮০ ও ৯০ গেজের কাপড় দিয়ে ফোল্ডিং ব্যাগ, জুয়েলারী পার্টসসহ ছয় প্রকার ব্যাগ বানানো হয়। আকার ও নকশা অনুযায়ি একটি ব্যাগ তৈরি করে কারিকররা এক টাকা থেকে দু’ টাকা পেয়ে থাকে। এক একজন শ্রমিক প্রতিদিন অনায়াসে বিভিন্ন আকৃতির ২০০ থেকে ২৫০টি ব্যাগ সেলাই করতে পারেন। অনেকে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করার পর পড়াশুনা ও সাংসারিক কাজ সেরে বাড়িতে বসেও রাতে ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ করে থাকেন। ফলে তালা উপজেলার গোপালপুর, খড়েরডাঙি, বারুইহাটি, উত্তর নলতা, গোনালী, শাহপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কিছু মানুষ এ কারখানায় কাজ করে তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন।

প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার ব্যাগ এ কারখানায় তৈরি করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে ঈদ উপলক্ষে উৎপাদন অনেক বেশি হচ্ছে। এজন্য শ্রমিকরা দিবা রাত্র ব্যস্ত সময় পার করছেন। ব্যাগ প্রতি উৎপাদন খরচ থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা লাভ করে তিনি প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ করে থাকেন। দেবনীলা এন্টারপ্রাইজ থেকে কাজ শিখে তালা উপজেলাসহ সাতক্ষীরা শহরের কমপক্ষে ১২জন নিজ উদ্যোগে কারখানা তৈরি করেছেন। সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান ও বাজারজাত করনের ব্যবস্থা থাকলে দেবনীলা এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানটি আরো কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে এলাকার অনেক নারী ও পুরুষের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতো।

কলেজ ছাত্রী শিউলি খাতুন জানান, তার বাড়ি নলতা গ্রামে। বাবা দিন মজুর। সংসারে আটজন সদস্য। বাবার একার আয় দিয়ে সংসার খরচ সঙ্কুলান হয় না। এর উপর তার ও ভাইদের পড়ার খরট যোগাড় করা সম্ভব হয় না। তাই নিজের ও ভাইদের হাত খরচের সঙ্গে পড়াশুনার খরচ যোগাতে ব্যাগ সেলাই করে থাকেন। বাড়ির কাজ ও পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে যে সময় পান সে সময়ে ব্যাগ সেলাই করে মাসে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জন করেন। প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ করছেন উল্লেখ করে শিউলি বলেন, তার ইপার্জিত টাকা দিয়ে বাড়িতে দু’টি সেলাই মেশিনও কিনেছেন। যা’ থেকে মা ও বোন কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করতে পারে।

শিউলি খাতুনের বান্ধবী সাবিনা খাতুন জানান, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্যাগ সেলাই করি। আয় করে নিজেদের খরচ চালাতে পেরে নিজেদের সাবলস্বী বলে মনে হয়। এতে সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কলেজ ছাত্রী মঞ্জু ও মরিয়ম বলেন, এখানে পরপর কাজের প্রসার বাড়ছে। ফলে এলাকার নারীরা আয়ক্ষম হওয়ায় তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

গৃহবধু স্বপ্নময়ী সাহা জানান, সকালে বাড়ির কাজ করে ৮টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত এ কারখানায় কাজ করে ২০০ টাকারও বেশি আয় করে থাকেন। এরপর বাড়ি যেয়ে সকল সাংসারিক কাজ করে রাতে মেশিনে বসে শতাধিক টাকা আয় করে থাকেন।

নাজমা বেগম বলেন, বাড়িতে হাঁস মুরগি ও ছাগল পালন করতেন। স্বামী প্যারালিসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর ওইসব প্রাণী বিক্রি করে এ কারাখানায় কাজ করে সংসার ধরে রাখেন। দেড় বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর ব্যাগ সেলাই করে দু’ ছেলের পড়াশুনার খরচ যোগানোর পাশাপাশি নিজের সংসার সচল রেখেছেন। এভাবে ৩০ জনের বেশি গৃহকধু এ কারখানায় কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরশেন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপ ব্যবস্থাপক ফারুকী নাজনিন জানান, তালা উপজেলার মাঝিয়াড়া ছাড়াও বারুইহাটি, সাতক্ষীরা শহরসহ কয়েকটি স্থানে শপিং ব্যাগ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এখানকার উৎপাদিত ব্যাগ জেলার বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে বহু লোকের আত্মকর্মসংস্থান হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থার পাশপাশি তারা এ ধরণের প্রজেক্টের উপর প্রশিক্ষন ও ঋণ দিয়ে কারখানাগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য উদ্যোগ নেবেন।

(আরকে/এএস/জুলাই ০২, ২০১৬)