অমর চন্দ্র দাস

গত ২৭ ডিসেম্বর (২০১৫) বহুল প্রচারিত ‘‘স্বদেশ খবর’’ পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংবাদ ছিল এরকম- ‘জবির বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হোসনে আরা জোলির সাম্প্রদায়িক আচরণের শিকার অধ্যাপক চঞ্চল কুমার বোস।’ বিস্তারিত সেই সংবাদে ছিল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক চঞ্চল কুমার বোস নিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসনে আরা জোলির দ্বারা সাম্প্রদায়িক অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় ওই শিক্ষিকার বিচার ও শাস্তির দাবিতে উপাচার্য বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন অধ্যাপক চঞ্চল কুমার। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ১৩ ডিসেম্বর ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটিকে ২ সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেন ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। তদন্ত কমিটি গঠনের ১ দিন পর ১৪ ডিসেম্বর কাউন্টার অভিযোগ(মিথ্যা) হিসেবে অধ্যাপক ড. হোসনে আরা জোলি ভিসি বরাবর অধ্যাপক চঞ্চল কুমার বোসের বিরুদ্ধে হয়রানি ও ইভ টিজিংয়ের পাল্টা অভিযোগ করেন। ভিসি অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। উল্লেখ্য, ১০ ডিসেম্বর(২০১৫) অধ্যাপক ড. হোসনে আর জোলি কথাবার্তার এক পর্যায়ে ড. চঞ্চল বোসকে জুতা মারবেন বলে হুমকি দেন এবং নমঃশূভ্র বলে গালি দেন। ঘটনা যাই থাকুক না কেন, চঞ্চল বোসের সঙ্গে যে সাম্প্রদায়িক আচরণ করা হয়েছে তা দুঃখজনক। এর সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি হওয়া জরুরি।

১১ এবং ৬ জানুয়ারি (২০১৬) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অনুষ্ঠানে মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকদের অনেক উঁচুতে অবস্থান বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ৪ জানুয়ারি মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সচিবদের সঙ্গে তুলনা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ শিক্ষকরা সচিবদের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে অন্যরকম চিত্র রয়েছে। আসলে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো কোনো শিক্ষকের মানসিকতার সংকীর্ণতা এবং ছাত্রদের ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরের সহিংস আচরণের কিছু দৃশ্যপট স্মরণ করলে আঁতকে উঠতে হয়। অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা চিন্তায় অগ্রগামী; এবং দেশ ও জাতির কল্যাণভাবনায় উদীপ্ত। তাঁদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে হীন মানসিকতার শিক্ষকদের স্বরূপ উন্মোচন জরুরি।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের গণ্ডির মধ্যে নিজের জীবন আটকে রেখে শিক্ষকতাকে কেবল চাকরি হিসেবে গ্রহণ করে কিছুসংখ্যক শিক্ষক ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার মধ্যে নিজেকে ধন্য করে তুলেছেন। তাঁদের ক্ষুদ্র চিন্তার জগৎ শিক্ষার্থীদের কিভাবে স্পর্শ করে, সেই বিষয়েও আলোকপাত জরুরি। মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র নামধারী ঢাকার দোকানপাটে হামলা চালিয়ে, বাস বন্ধ করে একাডেমিক পরিবেশ বিঘিœত করে এবং হুমকি দিয়ে লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যায়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের উচ্ছৃঙ্খল ও সহিংস আচরণের পেছনে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের ইন্ধন রয়েছে। আসলে উপাচার্যকে বিব্রত করার জন্য ছাত্রদের অপতৎপরতার সঙ্গে কিছু সংখ্যক শিক্ষকের প্ররোচনা জড়িত থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাম্প্রদায়িক আচরণ নতুন কিছু নয়। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সেলিম মোজাহার চঞ্চল বোসকে ‘মালাউন’ বলে গালি দেয় এবং গলা কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে বলে হুমকি প্রদান করে। ২০১২ সালের সেই ঘটনায় তৎকালীন উপাচার্যকে অভিযোগ প্রদান করা হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ক্ষুদ্র মানসিকতার এসব শিক্ষক অন্য শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বাসে যাওয়া-আসার সময় রসাল গল্প করে। তাঁর কাজের বুয়াকে জিজ্ঞেস করে, রহিম নামক শিক্ষকের বাসায় ছাত্রীরা যায় কি না? বুয়া সেই কথা রহিমকে জানায়; এবং সে আরো জানায়, ওই শিক্ষক তাকে পা টিপে দেওয়ার কথা বলে, এই ইঙ্গিত সে ভালোই বোঝে। ইদ্রিস নামের অন্য এক শিক্ষক জাকির নামে শিক্ষককে সুজাতা নামের ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি(জাকির) অবাক হন। ইদ্রিস জানান, সুজাতা তার বয়ফ্রেন্ড আরিফকে নিয়ে কক্সবাজারের কোনো হোটেলে রাত্রীযাপন করে এসেছে। জাকির মনে করেন, এটা সেই ছাত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা তাঁর রুচিতে বাধে। নোংরা মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় কোনো কোনো সিনিয়র অধ্যাপকদের কাছ থেকেও। কোন এক বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতার জন্য একজন সিনিয়র শিক্ষকের শরণাপন্ন হলে তিনি বলেন, ‘আপনাকে সেখানে সুযোগ দিলে তো ছাত্রীদের সঙ্গে লীলাখেলায় মেতে উঠবেন।’ স্বল্প বেতনপ্রাপ্ত ওই জুনিয়র শিক্ষককে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে নিজের জীবন নির্বাহ এবং মা-বাবার ব্যয়ভার বহন করতে হয়। জীবিকার জন্য তাঁর পার্টটাইম চাকরির প্রয়োজনকে এভাবে দেখার কী অর্থ আছে? যে বিএনপি-জামায়াতপন্থী অধ্যাপক অন্য এক প্রভাষককে লম্পট বলেছেন, দেখা গেছে, কিছু দিন আগে সেই অধ্যাপকেরই নামে নোংরা লিফলেট বেরিয়েছে। গত বিএনপি-জামায়াত জোট এবং সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় এবং চারটি দ্বিতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত ব্যক্তি শিক্ষক হওয়ার পর নিজেদের স্বার্থে দলীয় পরিচয় ভুলে এক হয়ে গেছেন। লিপ্ত হয়েছেন চঞ্চল বোসের মতো মেধাবী শিক্ষকদের চরিত্র হননে।

এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষকের সংকীর্ণ চিন্তার কথা। এর বাইরে কলেজ ও স্কুলের চিত্র একই রকম। ঢাকার একাধিক স্কুলের শিক্ষকদের সম্পর্কে অভিযোগ হলো, তাঁর ব্যাচে প্রাইভেট পড়লে শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে ভালো আচরণ পাবে। অন্যথায় একই শ্রেণিতে একাধিকবার থাকতে হতে পারে। গত কয়েক বছর আগে দেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, খুলনার এক ছাত্রীকে বেত্রাঘাত করে মারাত্মক আহত করেছেন এক শিক্ষক। অভিযোগ আছে, ওই ছাত্রী সেই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়নি, তার সামর্থ্যও নেই। তাই এর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। দরিদ্র ছাত্রীটির পক্ষে কথা বলবে কে? কিছু দিন আগে সরকারি কলেজের ইংরেজির এক শিক্ষক আমাকে বলেছেন, ‘আপনাদের বেতন না তুললে তো বাসা ভাড়া দিতে পারেন না। আর আমি গত আট মাসে নিজের বেতন তুলিনি।’ এটা তাঁর প্রাইভেট পড়ানোর কৃতিত্ব। তিনি শহরে ৬৫ লাখ টাকায় ফ্ল্যাটও কিনেছেন। কোনো কোনো শিক্ষকের হীন মন-মানসিকতা ও আচরণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক দিনের পর দিন ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হলে এক সপ্তাহে ক্লাস নিয়ে সেমিস্টার শেষ করেন, তাঁকে ছাত্ররা আড়ালে তিরস্কার করে। হীন মানসিকতার প্রভাবে চিন্তা-ভাবনায় যেমন সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতায় শিকড় গেড়ে বসেছে, তেমনি কথায় কথায় সহিংস হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। উল্লেখ্য, ছাত্রদের আচরণে কেবল শিক্ষক নন, অন্যান্য বিষয়ও প্রভাবক হিসেবে কার্যকর। বংশগত পরিচয়, রাজনৈতিক কদাচার এবং বিনোদনের অভাবে বিকৃতির দ্রুত প্রসার ঘটছে। আরো আছে মাদক সেবন, লেখাপড়ার চেয়ে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা, টেন্ডারবাজি এবং রাজনৈতিক সমর্থক হিসেবে দাপট ফলানোর মতো ঘটনা। আছে গ্রুপ হিসেবে এক দিক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হলে সেই পক্ষে কাজ করার প্রবণতা; অপর পক্ষকে দমানোর চেষ্টা। ছাত্র নেতৃত্বের ব্যর্থতাও আছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। চেইন অব কমান্ড নেই ছাত্ররাজনীতিতে। কেউ কারো কথা শোনে না। এই সুযোগে জামায়াত-শিবির ধর্মের নামে রাজনীতির মাঠ তপ্ত করে তুলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নোংরা ও সহিংস আচরণের প্রতিকার অন্বেষণে প্রথমেই মনোযোগ দেওয়া দরকার সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি এবং সমাজের আন্তসম্পর্ক আচরণবাদের মূল বিষয়। খারাপ আচরণ এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দূরত্ব সৃষ্টি করে। ব্যক্তির আচরণ নির্ভরশীল তার মনস্তত্ত্বের ওপর। পশুর চেয়ে মানুষের বিশ্বাস, আশা-আকাক্সক্ষা স্বতন্ত্র। শারীরিক গঠন, সামাজিক সংযোগ এবং ইতিহাসের শিক্ষা মানুষকে পরিশীলিত করতে পারে। এক পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে অন্য পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ব্যক্তির আচরণ ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ জন্য স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণই কাম্য। শিক্ষকদের প্রগতিশীল চিন্তা এবং সূক্ষ্ম অনুভূতি ভালো আচরণের পূর্বশর্ত। আদর্শ মানবসমাজে মানুষ তা-ই করে, যা তার প্রয়োজন। পরনিন্দা ও পরচর্চা পরিহার করে এবং আত্মস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার মধ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার শিক্ষকদের বর্তমান সংকট মোচন সম্ভব বলে মনে করি।


লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বরগুনা সরকারি কলেজ