বিউটি আক্তার হাসু : ‘চলো না যাই বসি নিরিবিলি দুটি কথা বলি, নিচু গলায়। আজ তোমাকে ভুলাবো আমি আমার মিষ্টি কথামালায়।’ হ্যাঁ, মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে কারও মন ভোলাতে না পারলেও নুহাশ পল্লীর শান্ত ও নীরব পরিবেশ হৃদয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। পাশে প্রিয়জন কেউ থাকুক আর না-ই থাকুক চারপাশের স্নিগ্ধ-শ্যামল রূপ এক নির্মল আনন্দে মনকে আবিষ্ট করে রাখবে সারাদিন। কী এক অদ্ভুত ভালো লাগা বুকের ভেতর দোল দিয়ে যাবে, লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সহকর্মী ফাল্গুনীকে নিয়ে রওনা হলাম ঢাকার যানজট ছাড়িয়ে কোলাহলমুক্ত নুহাশ পল্লীর একান্ত নিরিবিলি, নির্জন পরিবেশে। খালাম্মা মানে ফাল্গুনীর মাও আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। গাজীপুর জেলার হোতাপাড়ায় পিরুঝালীর নিবিড় অরণ্যে ‘নুহাশ পল্লী’ অবস্থিত। যেখানে কোনো গাড়ির শব্দ নেই, শুধু কান পেতে শোনা যায় সবুজ বৃক্ষরাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাখির কলকাকলি। বৃক্ষের শ্যামল ছায়ায় বিশুদ্ধ বাতাসে শরীর শীতল হবে, স্নিগ্ধ-সতেজ আবেশে মন হবে মুগ্ধ; তেমনি সারি সারি গজারির সবুজ রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর ছেড়ে আমরা জয়দেবপুর পৌঁছলাম সকাল ৮টার দিকে। সেখান থেকে ২০ কিলোমিটারের মতো দূরে নুহাশ পল্লী।

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়হৃন আহমেদ তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ‘নুহাশ পল্লী’র শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন। একজন মানুষের কল্পনাশক্তি কত শক্তিশালী হলে এত সুন্দর বাসস্থান গড়া সম্ভব, নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না! নুহাশ পল্লীর প্রধান ফটকের ডান পাশে মা-ছেলের সাদা ভাস্কর্য কিছুক্ষণের জন্য আপনার গতিরোধ করবে। আরেকটু সামনে এগুলেই সুইমিং পুল, পাশেই একটি বিশাল ড্রাগনের প্রতিমূর্তি। সেই সঙ্গে নানা রঙের ফুল ও গাছের ছায়ায় ঘেরা একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন, যে ভবনটিতে কথাসাহিত্যিক হুমায়হৃন আহমেদ ঘুমাতেন। সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাসভবনের জানালার পাশে হাতে ফলের ডালি নিয়ে দাঁড়ানো সুন্দরী রমণীর চিত্রমূর্তি (প্রতিচিত্র) নুহাশ পল্লীতে আগত উৎসুক, ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীদের উদ্দেশে যেন বলছে- ‘ফুলের অঞ্জলি হাতে ছুঁয়ে দিতে দাও যেও না, যেও না; একটু দাঁড়াও। একটুখানি বসে যাও।’

পাশেই বসার টেবিল ও চেয়ার পাতা রয়েছে। ভবনের পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি পুকুর। পুকুরের পাশে দাঁড়ানো তাম্রবর্ণের মূর্তিটি যেন হাত উঁচিয়ে দুষ্টু ছেলের দলকে সাবধান করছে- ‘খবরদার! পুকুরে ঢিল ছুড়বে না।’ সামনে সুপ্রসারিত মাঠ, যেন সবুজ কার্পেটে মোড়ানো। মাঠের একপাশে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। মাঠের মাঝখানে একটি গাছ, যে গাছটির ওপর দুটি ছোট ছোট কাঠের ঘর। কতটা রসিক মনের, ব্যতিক্রম চিন্তার অধিকারী হলে এমন মজার চিন্তা মাথায় আসে?

যে গানের কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছি, সেই গানটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ছবির। এই গানটি ছবির নায়িকা গাছটির সঙ্গে লাগোয়া কাঠের সিঁড়িতে বসেই গায়। আর নায়ক গাছের ছোট ঘরে বসে বই পড়তে থাকে। আরও সামনে এগুলে ডানে আরেকটি ভবন ‘বৃষ্টিবিলাস’, যেখানে শুটিং করতে গিয়ে ইউনিটের লোকজন থাকতেন। এখন ভবনটিতে কর্মচারীরা থাকেন।

সামনে নানা প্রজাতির গাছ লাগানো রয়েছে। গাছের গায়ে নাম এবং বৈজ্ঞানিক নামও লেখা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। বিশেষ করে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে যারা পড়াশোনা করে, তাদের জন্য বেশি জরুরি। গাছের ফাঁকে দেখা যায় ছোট্ট পুকুর, যেদিকে তাকালে মৎস্যকন্যার কৃত্রিম রূপে চোখ আটকে যায়, কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। পাশেই রয়েছে ভয়ঙ্কর ড্রাগনের মূর্তি, যা বাচ্চাদের আনন্দ দেবে। একটুখানি সামনে হাঁটলে জিরাফ, সজারুসহ বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে একটুখানি বসতে পারেন পাশেই সিমেন্টের তৈরি গোল স্তরে, কিংবা আরও বেশি মজা পেতে হলে দোলনায় বসে হাওয়ায় দোল খেতে পারেন।

আরেকটু সামনে ‘লীলাবতী’ দীঘি। লীলাবতী দীঘির পাশে সিমেন্টে খোদাই করা লেখা রয়েছে- ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছে নয়ন নয়নে।’ দীঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সুন্দর ব্রিজ বা সেতু, চারপাশে সারি সারি সবুজ গাছ। এমন মনোহর দৃশ্য অবলোকনে কার মন না আকৃষ্ট হবে! দীঘির স্বচ্ছ জলে গাছের ছায়া পড়ে এক মায়াবী দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। দীঘির জলের সঙ্গে সবুজ গাছের যেন গভীর মিতালি হয়েছে- সত্যিই তুলনাহীন! দুর্নিবার ইচ্ছে ছিল ‘লীলাবতী’র টলমলে পানিতে একটু পা ভেজাতে, কিন্ত পানি সিঁড়ির নিচে নেমে যাওয়ায় সম্ভব হলো না। দীঘির পাড়ে পাশেই ‘ভূতবিলাস’ ভবনটি আপনার দৃষ্টি কাড়বে।

অন্যপাশে শুটিংয়ের জন্য একটি মাটির ঘরও রয়েছে। নুহাশ পল্লী শুধু খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নপুরী নয়, আমাদের সবার শান্তির পটভূমি। তাই নুহাশ পল্লী রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিতভাবে আমাদের সবার। আর একুশে বইমেলায় তার বইয়ের জন্য ভক্ত পাঠকদের উপচে-পড়া ভিড় দেখা যাবে না, তার বইয়ের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ হবে না। আমরা তার মজার সাহিত্যকর্ম থেকে বঞ্চিত হব; কিন্তু তার সৃষ্টি ও কর্মের প্রতি যত্নবান হয়ে আমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারি। তার সৃষ্টি ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, কবর জিয়ারত করতে আসা লোকজনের জন্য আলাদাভাবে রাস্তা ও সীমানা নির্ধারণ করে বেড়া দেয়া হলেও দর্শনার্থীরা নুহাশ পল্লীতে জোর করে ভেতরে প্রবেশ করতে চায়।

তিনি আরও বলেন, দর্শনার্থীদের অনেকে বাইরে থেকে খাবার ও পানীয় সামগ্রী এনে ভেতরের পরিবেশ নোংরা করছেন। পয়:নিস্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র প্রস্রাব-পায়খানা করে পরিবেশ দূষিত করছেন। ভেষজ উদ্ভিদ বাগানের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কেউ কেউ গাছের পাতা তুলে ফেলছে কিংবা গাছও উপড়ে দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। কিন্তু এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ আমাদের কারও কাম্য নয়। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে যারা শ্রদ্ধা করেন, তার লেখাকে যারা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেন তাদের পক্ষে এ রকম কাজ করা সম্ভব নয়। আমাদের সবার উচিত নুহাশ পল্লীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে ও দেখভালের কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের সাহায্য করা। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

যেভাবে যাবেন : গুলিস্তান থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাসে যেতে লাগবে ৭০-৮০ টাকা। এরপর টেম্পোতে নুহাশ পল্লী পর্যন্ত যেতে লাগবে ৫০-৬০ টাকা। আসা-যাওয়ার জন্য ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পকেটে ভরে বেরিয়ে পড়তে পারেন ‘নুহাশ পল্লী’র শান্ত, রূপ-মাধুর্যে চোখ জুড়াতে, মন ভরাতে। তাহলে আর দেরি কেন?

(বিএএইচ/এএস/জুলাই ১৯, ২০১৬)