এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক : গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরিপাটি চেহারার ভদ্রলোক মামলা করেছেন থানায়। আসামী একজন তরুণ স্কুল শিক্ষক। ভদ্রলোকের অভিযোগ, শিক্ষক বেচারা ভদ্রলোকের স্কুল পড়ুয়া নাবালিকা মেয়েকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

অপরাধ খুবই গুরুতর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় যুবক শিক্ষক অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সহসা জামিনের আশা নেই। কারণ, প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন দেয়ার এখতিয়ার সাধারণত নিম্ন আদালতের নেই। সে কারণে অভিযোগকারী ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন আসামীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে শিক্ষক বেচারা গা-ঢাকা দিয়েছে। বাড়িতে আছেন কেবল যুবক স্কুল শিক্ষকের মা-বাবা এবং কথিত অপহরণ করা কিশোরী মেয়েটি।

মামলার এফ.আই.আর সহ মামলাটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। সরকার পক্ষে কোর্ট ইন্সপেক্টর (পুলিশ) আদালতকে বলছেন, হুজুর আসামী খুবই দুর্দান্ত ও প্রভাবশালী। সে ভিকটিম তথা কিশোরী মেয়েটিকে ফুঁসলিয়ে অপহরণ করে নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছে। কোর্ট ইন্সপেক্টর আদালতের কাছে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারার বিধান মতে, আসামির বাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে বে-আইনীভাবে আটক মেয়েটিকে উদ্ধারের অনুমতি প্রার্থণা করেন। আদালত কোর্ট ইন্সপেক্টরের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং আসামীর বাড়িতে তল্লাশীর পরোয়ানা ইস্যু করেন। পুলিশ অবিলম্বে এ পরোয়ানার ভিত্তিতে ওই আসামীর বাড়িতে তল্লাশী চালায় এবং মেয়েটিকে উদ্ধার করে আদালতে সোপর্দ করে।

ঘটনাটি ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবরের। মেয়েকে উদ্ধার করার পর সেই মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে স্বীকার করে যে, সে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, অন্যের বিনা প্ররোচনায়, সুস্থ মস্তিষ্কে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে চলে গেছে। অন্যদিকে পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (২০০০ সালের ৮নং আইন) মতে, চার্জশিট দাখিল করেন।

সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও নারী বা শিশু অপহরণের সংবাদ আমাদের দৃষ্টি গোচর হয়। সেকারণ অপহরণ শব্দের সঙ্গে আমাদের সবারই কম-বেশি পরিচিতি রয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে অপহরণ সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। এখন দেখা যাক, নারী ও শিশু অপহরণ বিষয়ে আইন কি বলে।

নারী ও শিশু অপহরণ বলতে বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৩৬২ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে কোন স্থান হতে গমন করার জন্য জোরপূর্বক বাধ্য করে বা কোনো প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ করে সে ব্যক্তি উক্ত ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে বলে গণ্য হবে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা অপহরণের দুটি উপাদান পেয়ে থাকি। প্রথমত বলপূর্বক বাধ্য করা বা প্রতারণামূলকভাবে প্রলুব্ধ করা, দ্বিতীয়ত কোনো ব্যক্তিকে এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা।

এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অন্যূন ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।

এ পর্যায়ে আলোচনার পূর্বে আমরা আরও ভালোভাবে জেনে নিই অপহরণ কাকে বলে? বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইনের ৩৬১ ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, আইনানুগ অভিভাবকত্ব হতে মনুষ্যহরণ।

আইনের বিধান মতে, 'যে ব্যক্তি পুরুষের ক্ষেত্রে ১৪ বছরের কম বয়স্ক বা নারীর ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম বয়স্ক কোনো নাবালক বা কোনো অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির আইনানুগ অভিভাবকের তত্ত্বাবধান থেকে অনুরূপ অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে লইয়া বা প্রলুব্ধ করিয়া লইয়া যায়, সেই ব্যক্তি অনুরূপ নাবালক বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে আইনানুগ অভিভাবকত্ব হতে অপহরণ করে বলে গণ্য হবে।'

এখানে উল্লেখ্য, দন্ডবিধির এ ধারায় 'স্বেচ্ছায়', 'স্বজ্ঞান', 'অসাধুভাবে', 'অন্যের বিনা প্ররোচনায়', 'সুস্থ মস্তিষ্ক' ইত্যাদি শব্দের কোনো রকম ব্যবহার করা হয়নি। তবে বয়সের সীমারেখা বেঁধে দেয়া রয়েছে। যেমন মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৬ বছর এবং শিশুদের ভুলিয়ে বা ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেলে এ ধারায় অপরাধ সংঘটিত হবে।

যেহেতু এজাহারটি হয়েছে অপহরণের এবং পুলিশ চার্জশিট দাখিল করেছে, অন্যদিকে মেয়েটি ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ (১৮৯৮ সালের পঞ্চম আইন)-এর ১৬৪ ধারার বিধান মতে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে, সে স্বেচ্ছায়, সুস্থ মস্তিষ্কে এবং অন্যের বিনা প্ররোচনায় স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে চলে গেছে। তাই আইনের বিধান অনুযায়ী এ মামলায় চার্জ শুনানির মাধ্যমে মামলা থেকে ছেলেটির অব্যাহতি লাভের সুযোগ রয়েছে এটা পরিষ্কার। কেননা ভিকটিম মেয়েটির বয়স ১৯ বছর, আইন মতে সে সাবালিকা। আইনের বিধান মতে, ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত কোনো মেয়ে তার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তবে ১৮ বছর বয়স হলে সে তার ইচ্ছেমতো যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে এবং যে কোনো চুক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।

এখানে উল্লেখ্য, ভিকটিম সাবালিকা হিসেবে তার ভালো-মন্দ বুঝার ক্ষমতা ও বিবেক-বুদ্ধি রয়েছে এবং বাংলাদেশের আইন মতে যে কোনো সাবালিকা, সুস্থ মেয়ে (সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন) বাবা-মা বা অন্য কোনো আইনানুগ অভিভাবকের বিনা সম্মতিতে নিজের ইচ্ছেমতো যাকে খুশি তাকেই সে বিবাহ করতে পারবে। এ স্বাধীনতাটুকু দেশীয় আইনে স্বীকৃত, এমনকি পৃথিবীতে মানবাধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও আন্তর্জাতিক আইন অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারে সার্বজনীন ঘোষণাপত্রেও নাকি পুরুষের বিবাহের বা সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে মেয়েদের জন্য ১৮ বছর বয়স বিবেচনা করেই। কাজেই আমাদের দেশের জাতীয় আইন মতে, মেয়েটি নিজের খুশিমতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে কিংবা বিবাহের জন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে অভিভাবকের অমতে বাড়ির বাইরে যেতে পারে। কেননা আমাদের জাতীয় আইন ও সংবিধান প্রত্যেকের স্বাধীনতাকে সম্মান প্রদর্শন করেছে যদি সেই মেয়ে ১৮ বছর এবং ছেলে ২১ বছর বয়সী হয়। সে কারণে মেয়েটি বাবা-মায়ের অজ্ঞাতে একজনকে বিয়ে করতেই পারে।

পাশাপাশি পুলিশ যেসব সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট দিয়েছে তা আদালতে আসামীর বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না। কারণ এখানে মূল সাক্ষী ভিকটিম মেয়েটি নিজে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে সেটিই প্রাধান্য পাবে এ মামলায় এবং সেটাই বিবেচ্য বিষয়। আর মেয়েটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকার করেছে যে, সে স্বেচ্ছায় স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে চলে গেছে।

মামলাটির চার্জ শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য হলো। আসামীর আইনজীবী ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ (গ) ধারার বিধান মতে এ মামলা থেকে আসামীকে অব্যাহতি লাভের আবেদন জানালেন। এবং আদালতে নিম্নলিখিত যুক্তি উপস্থাপন করলেন।

* আসামি একজন শিক্ষিত যুবক, বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক এবং প্রচলিত আইনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল।
* আসামীর বিরুদ্ধে মামলায় উল্লেখিত ধারার কোনো উপাদান নাই।
* ভিকটিম স্বেচ্ছায় আসামীর সঙ্গে গেছে। সে মতে এটা কখনোই অপহরণ হতে পারে না।
* ভিকটিমের বয়স ১৯ বছর, সে নিজেই নিজের ভালো-মন্দ বুঝে ও জানে। সুতরাং তাকে ভুল বুঝিয়ে নেয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অবান্তর।
* ভিকটিম নিজে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বেচ্ছায় যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। সে কারণে পুলিশের মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক চার্জশিট ভিত্তিহীন এবং অকার্যকর।

ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘মোকদ্দমার নথি ও তৎসহ দাখিলি দলিলাদি বিবেচনা এবং তৎসম্পর্কে আসামি ও অভিযোগকারীর পক্ষের বক্তব্য শ্রবণের পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালাইবার কোনো পর্যাপ্ত হেতু নাই, তাহা হইলে আদালত আসামিকে অব্যাহতি দেবেন ও তদ্রুপ করিবার কারণ লিপিবদ্ধ করিবেন।’

অবশেষে বিচারক মহোদয় এই মর্মে আদেশ দেন যে, আসামি উল্লেখিত ধারায় কোনো প্রকার অপরাধ সংঘটন করেনি। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের বিধান বর্ণিত ও দন্ডবিধি মতে, অপহরণ মামলার কোনো উপাদান এখানে বিদ্যমান নেই। তাই আসামির বিরুদ্ধে ওই মামলা চলতে পারে না এবং সে মতে আসামীকে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ (গ) ধারা মতে অত্র মামলা দায় হতে অব্যহতি প্রদান করা হলো।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’।