ঘুমবউ

মেঘের ফাঁক গলে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে উঁকি দিতে না দিতে আবার ডুব। সকাল থেকে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। কিছুক্ষণ পর পর এক দলা কালো মেঘ উড়ে এসে প্রতাপশালী সূর্য দেবকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকে কান্তি বয়স্ক জাম গাছের গোড়ায় বসে বসে সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলাটার একমাত্র দর্শক। এরি মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে গেছে। আবারও আগাম পূর্বাভাষ ছাড়াই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। তার সেদিকে খেয়াল নেই। আলুথালু অবস্থা কান্তির। এ কয়দিনে চোয়াল বসে গেছে। মুখে ব্লেড পড়েনি বলে তাকে অচেনা মানুষের মতো দেখাচ্ছে এখন।

বৃষ্টি নামল সব কিছু ছাপিয়ে। তবু নড়ল না কান্তি। রাগ আর অভিমান তাকে এখানে আটকে রেখেছে। এবার দু হাত- পা সামনে মেলে দিয়ে বৃষ্টিস্নানে মন দেয়। সে যেখানে বসে আছে সেখানে লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে। সামনে বিরাট ফসলি জমি। পেছন পিযুষ কাকাদের পুকুর। এক সময় পুকুরটি এ পাড়ার মানুষের নিত্য প্রয়োজন মেটাত। এখন বাড়ি বাড়ি নলকূপ বসে গেছে। পুকুরের ভেতর-বাহিরে অবহেলা আর অযত্নের ছাপ। লতাপাতায় পুকুরটিকে ঘিরে রেখেছে। পানির রং পাল্টেছে, পানিতে এখন গন্ধ ছড়ায়। পুকুরটিকে দেখতে অবশ্য খারাপ লাগছে না।
কান্তি আজ কাজে যায়নি, সে নিজেও চাষবাস করে জীবন চালায়। ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা শেষ হলে শহরে গিয়ে চাকুরি করবে। দশটা-পাঁচটা ধরাবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত হবে। কিন্তু তার পিতা ইহলোক ত্যাগ করার সময় পুত্রকে দিব্যি দেয়, 'ও পুত বাপ দাদার কাম ন ছাড়িচ। কি দরকার পরজিযে পরের গর দিবাল্লাই'। পিতা গণনবাবুর কথা খুশিমনে মেনে নিয়ে চাষবাসে জীবনকে আটকে ফেলেছে কান্তি। এই গ্রামীন-জীবনে সে বেশ ভালো আছে। কিন্তু তার একমাত্র দুঃখ স্ত্রী 'হেনা'। 'এই মাইয়া পোয়া আরে বঁর বিপদে পেলায়ে-ই'। - ইদানিং নিজেকে নিজে শোনায় কান্তি। স্ত্রী হিসেবে হেনা ঘরকন্নায় বেশ নিপুনা হলেও কান্তির ব্যাপারে বেখেয়ালী। একটু ভুল হলো সব ব্যাপারে নয়, মাত্র একটা ব্যাপারে হেনাকে সে 'নিপুনা'বলতে রাজি নয়। একবার বন্ধু সাধন ঘোষের কাছে আমতা আমতা করে কথাটা খুলে বলল সে। সাধন সহাস্যে বলেছিল, 'বেড়া সরমান্দে মাইয়াপোয়ার কাছে শরমের কি!' মনে মনে কান্তি বলে, 'ওরে কাবিল বেগ রোগের কবিরাজ অঁইয়ুুছ দে নাহ।' বন্ধুর ওপর রাগ ধরে কান্তির।
না কোনো বুদ্ধিতে, কোনো কথাতে হেনাকে লাইনে আনতে পারেনি সে। এক মনে হেনার ওপর রাগ করতে পারে না, আবার আরেক মনে প্রচণ্ড রাগ হয়। আজ তাই রাগ চরমে উঠেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। জমিতে গেল না, বাজারমুখো হলো না, যায়নি বন্ধুদের ভীড়েও। একা একা এই নির্জন জায়গায় বসে আছে। সে ভেবে রেখেছে আজ ঘরে ফিরবে না-দুপুরেও না, এমনি সন্ধ্যায়ও না। ঠিক করেছে-যখন রাত গভীর হবে তখন চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়বে। কাউকে বিরক্ত করবে না। কেউ যখন তার কথা ভাববে না, তখন কী দরকার খামোখা ঝনঝন করার!

সময় কত? বোঝার উপায় নেই। কান্তি আন্দাজ করতে পারে না। সে উঠে দাঁড়ায়। সে ঘরে ফিরবে না। উত্তরের জমির আলপথ ধরে সোজা হাঁটতে থাকবে। তারপর রাত নামার অপেক্ষা করবে। লুঙ্গির বাঁধন খুলে আবার শক্ত করে পড়ল। জমিতে নেমে পড়ে কান্তি। আজ মন তার উদাস। ছেলেবেলার মতো ফড়িং ধরার চেষ্টা করলো। পারল না। কিছুদূর যেতে একটা ফিঙে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, 'কান্তি ফিঙে পাখি অইলে ভালা অইতো'। আরেকটু সামনে যেতে শালিকের দল দেখে থামে, বলে, 'কান্তি শালিক অইলে ভালা অইতো।'
কান্তি পরিশ্রান্ত হয়ে জমিতে শরীর ছেড়ে দেয়। চোখ বোজে...

সন্ধ্যা নামে দিগন্ত জুড়ে। কান্তি এবেলাটা একঘুম দিয়ে উঠেছে। তারপর রাত গভীর হলে বাড়ির পথ ধরল সে। অন্ধকারে তার হাঁটতে অসুবিধা হবার কথা নয়, কাদাপানিতে পা পিছলে যাচ্ছে দুবর্ল শরীরের কারণে; সারাদিনে পেটে দানাপানি পড়েনি যে। তার রাগ ধরে, তারপর নিজে নিজে বলে চলে-'আজিয়ে যদি হেনা মাগি ঘুম যা, এতির এক দিন কি আরঁ এক দিন। আজইয়ে এতিরে শেষ গরি ফেলাইয়ুম...!'
কান্তির রাগ হওয়ারই কথা। প্রতিদিন রাতে কান্তির স্ত্রী হেনা বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। বউয়ের ঘুমন্ত মুখ দেখে দেখে প্রায় রাত ভোর হয় তার। কথাটা হেনাকে অনেকবার বলেছে, প্রতিবার হেনা বলে, 'অ ভগবান তুই আরে ন তুলিবা। তুই আরেঁ তুলিলে আইঁ উডি যাইতাম।'
হেনার অন্য কোনও সমস্যা আছে কিনা জানতে চেয়েছে কান্তি। নেই। হেনা বলেছে, 'হাল্লে ঘুম ছাড়া আরতে আর হোন সমস্যা নাই।'

কান্তি যখন বাড়ি ফিরে এল তখন প্রতিবেশীদের ঘরে আলো নিভে গেছে। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। চাঁদ এখনো মেঘের আড়ালে। শুধুমাত্র তার ঘরের আলো জ্বলছে। মনে মনে খুশি হয় সে। পা টিপে টিপে বন্ধ দরজায় সামনে থামে। দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল ভেতর থেকে। চমকে ওঠে কান্তি। সে ভেবেছিল, ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙাতে হবে। হেনা রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে নরম কণ্ঠে বলল, 'হারাদিন কড়ে আছিলে?'
গলা দিয়ে মেজাজ উগড়ে বের হতে চাইল কান্তির কিন্তু সে নিজেকে সামলে রাখল। আরো সামনে সরে এল হেনা, বলে, 'কথা ন হদ্দে কিল্লেই!'
কান্তি মুখ তুলে চাইল না। হেনার আলতো ছোঁয়া পড়ে কান্তির বাম গালে। তারপর হেনা মিহি গলায় বলে, 'আর এল্লে অতো নো, কথা দির। য হাত মুখ দুই আইয়ো, ভাত দির।'
- 'পেডোত ভোগ নাই।' ঝাঁ ঝাঁ স্বরে বলে কান্তি।
- 'পত পড়ির।'
- 'এত রাতিয়ে নাটক ন গরি ঘুম যাইতে য। ঘুম নষ্ট গরন ঠিক ন।'
- 'আইচ্ছে-'
হেনা কান্তিকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ দুজনের কেউ কথা বললো না। রাগ পড়ল কান্তির।
ভাব হলো চার চোখের। কান্তি কলতলায় গেল গুনগুন করতে করতে। পেটের খিদের কথা সে ভুলে গেছে। তার মনে হচ্ছে, এত রাতে ভাত খাওয়া ঠিক হবে না। হাত-মুখ ধুয়ে এসে ভাত খেতে বসল। হেনাকে বলল, 'ভাত কম খাই, কী ক?'
-'ন ন পেট ভরি খ। রাত বেশি ন অ।' হেনা বলল।

রাতের আহার পর্ব আনন্দ নিয়ে শেষ হয়। হেনা বিছানা-বালিশ ঠিক করে মশারি টানাতে টানাতে বলল, 'এখন ঘুম যাবে না, না আরো দেরি অইবো।
-'আইয়ের-'

কান্তি আবার বাইরে গেল। কলতলা হয়ে ঘরে ফিরেও এল তাড়াতাড়ি। সে দেখল-হেনা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কাছে এসে দেখে হেনা ঘুমের দেশের বাসিন্দা। কান্তি মশারির ভেতর ঢুকে পড়ে মেজাজ নিয়ে। কিন্তু রাগ প্রকাশের কোনো উপায় সে খুঁজে পায় না। শেষে ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে মরা মাছের মতো চেয়ে রইল সারারাত...