মৃন্ময়ী হাসান : শৈশবে অনেক শিশু যাচ্ছে বিগড়ে। বাচ্চাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় হিসেবে বাবা-মায়েরা অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে ধমকান, রাগারাগি করেন কিংবা মারধর করার মতো অস্ত্র ব্যবহার করেন। যখন কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না তখন তারা কেউ কেউ পেশাগত সাহায্য নিচ্ছেন, অনেকে আবার চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশা নিয়ে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

যদি প্রথম থেকেই সচেতন হওয়া যায় তাহলে এ ধরনের আচরণগত সমস্যা যাতে তৈরিই না হয়, সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বাবা-মা-ই প্রথম শিক্ষক
শিশুরা সাধারণত বড়দের অনুকরণ করে। আপনি যা করবেন, যেভাবে হাঁটবেন যেভাবে কথা বলবেন, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন সেও আপনার মতো করেই হাসছে, হাঁটছে, কথা বলছে। আবার ধরুন আপনি বাচ্চাকে বলছেন মিথ্যা বলবে না, কিন্তু আপনি তার সামনেই আপনার প্রতিবেশীকে পারিবারিক কোনো কোনো বিষয়ে মিথ্যা বলছেন, ধরা যাক একটা শাড়ির দামই বাড়িয়ে বলছেন। তাতে বাচ্চাকে আপনি যতোই নির্দেশনা দেন না কেন যে মিথ্যা বলবে না, সে কিন্তু ঠিক ঠিক আপনার কাজটিকেই অনুসরণ করবে। সুতরাং সন্তানের সামনে সব সময় সত্য বলুন। যদি তাকে চিৎকার করতে বারণ করেন তাহলে আগে আপনি চিৎকার করা থেকে বিরত থাকুন।

আদর নয় অতিরিক্ত
অতিরিক্ত আদর প্রদর্শন করবেন না, এর মানে এই নয় যে আপনি আপনার সন্তানকে আদর করবেন না বা কম আদর করবেন। তবে সেটা বেশি প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকুন। আমরা সবাই সন্তানকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের অজান্তেই অনেক সময় এর মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ করে ফেলি। যেমন- বাচ্চারা কোনো জিনিস চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে তা কিনে দেওয়া, ভুল আচরণে পুরষ্কার দেওয়া কিংবা সে কোনো অন্যায় করলে বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে।

যখন যা চাইবে তা দেয়া নয়
ধরুন আপনার বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর, সে আপনার কাছে একটি দামি মোবাইল ফোন চাচ্ছে, আপনি না করাতে সে ঘরের এটা-সেটা ভাঙচুর করছে বা কান্নাকাটি করছে। আপনি যদি এই অবস্থায় তাকে মোবাইল ফোনটি দিয়ে দেন সেটা হবে তার ভুল আচরণকে পুরস্কৃত করা। এরপর কোনো জিনিস চাইতে গিয়ে না পেলেই সে চিৎকার করবে কিংবা জিনিস ভাঙচুর করবে। কারণ ততদিনে সে বেশ বুঝে ফেলেছে এসব করলে শেষ পর্যন্ত জিনিসটি আপনারা তাকে অবশ্যই দেবেন। সুতরাং অতিরিক্ত স্নেহবশত তাকে অযৌক্তিক ভাবে এমন কোনো জিনিস দেবেন না যা তার ক্ষতি করতে পারে।

বন্ধু হন সন্তানের
মনে হতে পারে বাবা-মার জীবন তো সন্তানকে নিয়েই। প্রতিনিয়ত বাবা-মাতো সন্তানের জীবনের সঙ্গেই যুক্ত। যেমন- তাকে খাওয়ানো, পড়ানো, স্কুলে পাঠানো সব কিছুর সঙ্গেই বাবা-মা বরং বেশি যুক্ত। এখানে সন্তানের জীবন বলতে বোঝানো হয়েছে পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়ার বাইরেও তার নিজস্ব একটা জীবন আছে, সেটার অনেকটাই দখল করে আছে খেলা। শিশুরা খেলতে পছন্দ করে, গল্প করতে পছন্দ করে। আপনি হয়তো খেয়াল করবেন শুধুমাত্র মজার মজার গল্প শুনিয়ে একজন আত্নীয় আপনার চাইতে বেশি প্রিয় হতে পারে আপনার সন্তানের কাছে। এমনকি দেখা যায় তার সব কথা শুনছে। তখন হয়তো আপনার আফসোস হয় আমার সন্তান, তার জন্য এত কষ্ট করি অথচ সে আমার কথা শোনে না। তাই শিশুকে সময় দিন, তার সঙ্গে গল্প করুন, কখনো কখনো তার চাহিদা ও বয়স অনুযায়ী তার খেলার সঙ্গী হোন।


আচরণ হোক সন্তানের স্বভাব অনুযায়ী
সব বাচ্চা এক রকম নয়। কেউ খুব চঞ্চল আবার কেউ হয়তো একেবারেই চুপচাপ। কেউ বেশি আবেগপ্রবণ, কেউ হয়তো বুদ্ধির দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে। সুতরাং যে বাচ্চা চুপচাপ তার বেলায় নিয়ম বা আচরণ অবশ্যই চঞ্চল বাচ্চাদের মতো হবে না।

অগ্রসর হন বুদ্ধি দিয়ে
বাচ্চাকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে বড় করুন। একেবারে নিয়ম ছাড়া বড় হলে তার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ তৈরি হয় না। ফলে সে বড় হয়ে যখন যা ইচ্ছা তাই করে। চাইলেও সে তখন তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। যেমন- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা, সঠিক সময়ে খাবার খাওয়া, নিয়মিত পড়তে বসা, বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি।

বাচ্চার স্বাধীনতাটাও জরুরি
বাচ্চাকে বয়স অনুযায়ী স্বাধীনতা ভোগ করতে দিন। একেবারে ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে তারা যেহেতু বোঝে না তাই মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হয় বাচ্চা কোথায় কার সঙ্গে আছে এবং কি করছে। ঠিক তেমনি ভাবে যখন বাচ্চা ৮-৯ বছর বয়সী হয় তখন তাকে তার জিনিস পছন্দ করা, একা একা হোমওয়ার্ক করা, নিজের পছন্দমতো খেলতে দেওয়া প্রয়োজন। নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন যেমন বাচ্চার মধ্যে আত্ননিয়ন্ত্রণ তৈরি করে, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা বাচ্চাকে আত্ম নির্দেশনা দেয়। বাচ্চা ভুল করার মাধ্যমে সঠিক পথ বেছে নিতে শেখে। তবে অবাধ স্বাধীনতার বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। ভুলেও যেন ভুল না হয়ে যায়।

বজায় রাখুন একাগ্রতা
শিশুর জন্য যেমন নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা যেন সব সময়ই একই রকম থাকে। একেক সময় একেক নিয়ম কিংবা এক কাজে যখন তিরস্কার করছেন আবার অন্য সময় সেই কাজেই পুরস্কৃত করছেন এমনটি যাতে না হয়। তবে অবশ্যই পরিবারের সব সদস্য বাচ্চার ক্ষেত্রে একই নিয়মের ব্যাপারে একমত পোষণ করুন।

শাসন খুব কড়া নয়
শিশুরা কোমলমতি। সব সময় কড়া শাসনে সঠিক নিয়মে চলতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের ভুলগুলো সহজ ভাবে নিয়ে স্বাধীনতা ও নিয়মের মাঝে লালন পালন করাই শ্রেয়। অতিরিক্ত কড়া শাসনে শিশুর মনের চাহিদাগুলো পূরণ না হলে শিশু বদরাগী হয়ে উঠতে পারে। কিংবা লুকিয়ে কোনো কিছু করার প্রবণতা, মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।

শিশুকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন
শিশুকে কেন সকালে ঘুম থেকে উঠতে বলছেন, দাঁত ব্রাশ করতে বলছেন এরকম ছোট ছোট সব নিয়মই শিশুর কাছে ব্যাখ্যা করুন। তাতে সে তার ওপর বড়রা সব চাপিয়ে দিচ্ছে এমনটা মনে করবে না।

সন্তানকে সম্মান দিন
মনে হতে পারে সন্তানকে আবার সম্মান কিসের! বাচ্চা সম্মানের কি বুঝে! প্রতিটি মানুষ, হোক সে শিশু বা বয়ষ্ক, সবারই নিজের প্রতি সম্মানবোধ আছে। তাই শিশুর সঙ্গেও সম্মান রেখে কথা বলা উচিত। আপনি যদি আপনার বাচ্চার কাছে সম্মান পেতে চান তবে তাকেও সম্মান দিন। এর অর্থ তাকে সবার সামনে তিরস্কার করা, হেয় করা থেকে বিরত থাকুন। অন্য মানুষের সঙ্গে যেভাবে ভালো ব্যবহার করেন শিশুর সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করে কথা বলুন। তার মতামতকে গুরুত্ব দিন। সে কথা বলার সময় মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাতে আপনার শিশু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে ।

(ওএস/এএস/আগস্ট ১১, ২০১৬)