এনাম

স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই ক্যাম্প বসেছে। যুদ্ধে যেতে আগ্রহী এমন তরুণরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে-মুখে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয়। কেউ ওদের ডেকে আনেনি। ঘর থেকে জোর করেও ধরে আনেনি। দেশমাতৃকার চরম দুর্দিনে এ আসা যেন নিতান্তই সময়ের প্রয়োজনে।

ডাক্তার হারিছ আলী ঘুরে ঘুরে তরুণদের শারীরিক ফিটনেস যাচাই করছেন। যাদের বয়স চৌদ্দ বছরের চেয়ে বেশি, শারীরিক গঠন ভালো; কেবল তাদেরই তিনি নির্বাচন করছেন। ফলে দেখা যায়, যুদ্ধে যেতে আগ্রহী এমন অনেক তরুণই বাদ পড়েছে।

ডাক্তার সাহেব এনামের কাছে আসতেই বুক ফুলিয়ে সে সটান দাঁড়াল। ভাবটা এমন, যেন তার বয়স বারো-তেরো নয়, বিশ-বাইশ। এনামের শরীর স্বাস্থ্য ভালো। দেখতে ওকে বিশ-বাইশ বছরের বলেই মনে হয়। কিন্তু হলে কী হবে। ওর বয়স তো এখনো চৌদ্দই পার হয়নি।

ডাক্তার সাহেব ওকে হাঁ করালেন। দাঁত দেখলেন। ওর চারপাশে ঘুরে ঘুরে আরো যেন কী কী পরখ করেন। শেষে মুখখানা গম্ভীর করে বলেন, দুঃখিত! তোমাকে নিতে পারছি না। তোমার বয়স এখন চৌদ্দ হয়নি।

ডাক্তারের কথা শুনে এনামের মাথায় যেন রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা হবে বলে অনেক আগ্রহ নিয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। অথচ এই ডাক্তার এসব কী বলছে! বেঁকে বসে এনাম। তারপর বলে, আপনি বললেই তো আর হবে না। মা বলেছে আমার বয়স বিশ। তাই জলদি আমাকে পাস দিন।

ডাক্তার বুঝিয়ে বলেন, পাগলামো কর না ছেলে। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাও। তারা তোমার পথ চেয়ে আছে। এনাম এবার ডাক্তারের পায়ে পড়ে যায়। কাকুতি-মিনতি করে বলে, ডাক্তার চাচা। আমি এতিম। আমার বাবা-মা নেই। চাচার কাছে মানুষ। গরিব চাচা আমার ভার গ্রহণে অক্ষম। আমি বাড়ি থেকে শপথ করে এসেছি। মুক্তিযোদ্ধা হব। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলে তবেই বাড়ি ফিরব। তার আগে নয়। দয়া করে আপনি আমাকে পাসটা দেন।

এনামের প্রত্যয়ী কথাবার্তা শুনে ডাক্তার হারিছ আলী একেবারে থমকে যান। অবাকও হন। বারো-তেরো বছর বয়সের বাচ্চা ছেলে। অথচ কী প্রত্যয়ী কথাবার্তা। বিড়বিড় করে তিনি বলেন, এ দেশের স্বাধীনতা আর ঠেকায় কে? তরুণ প্রজন্ম যেভাবে জেগে উঠেছে। এই তরুণদের জন্যই দেশটা স্বাধীন হতে বাধ্য। তারপর এনামকে ধরে তিনি দাঁড় করান। জিজ্ঞেস করেন, বাড়ি কোথায়?

এনাম বলে, বিশ্বনাথের একনম্বর মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের কামালবাজার।

ওর পিঠ চাপড়ে এবার ডাক্তার বলেন, যুদ্ধ করা খুব কঠিন কাজ রে বাবা, খুব কঠিন কাজ। প্রথমে তোমাকে শক্ত ট্রেনিং নিতে হবে। তারপর না যুদ্ধ করা। তোমার যা কচি বয়স, পারবে বলে তো মনে হয় না। তবে তোমার মনের সাহস দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি তোমাকে পাস দিয়ে দিলাম।

এনাম ডাক্তারি পাস পাওয়ায় ওর সঙ্গী তরুণরা তাকে পরম সৌভাগ্যবান ভাবতে থাকে। আর নিজেদের দুর্ভাগা। কারণ তাদের প্রত্যেকের মনেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার তীব্র বাসনা। কিন্তু ডাক্তার সাহেব পাস না দিলে আর কী করা।

পুরো একটি দল ডাক্তারি পাস পায়। ডাক্তারি পাস নিয়ে সবাই ভারতে চলে যায়। এনামও দলের সঙ্গে যায়। দলটির সঙ্গে থেকে থেকে এনাম বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। রাইফেল চালানো, এলএমজি, এসএলআর চালানো, গ্রেনেড ছোড়া সব। বুকভরা সাহস আর মনভরা কৌত‚হল থাকায় খুব কম সময়েই সে পুরোপুরি প্রশিক্ষণ লাভ করে।

প্রশিক্ষণ শেষ করে এনাম দেশে এসে একটি নিয়মিত গেরিলা দলের সঙ্গে অপারেশনে নামে। বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর মধ্যে গ্রেনেড ছোড়া তার সবচেয়ে প্রিয়। সবসময় তার কোমরে একটি গ্রেনেড গোঁজা থাকে। গ্রেনেডের পিন খুলে সে চোখের পলকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

এদিকে সারা দেশে চলছে তুমুল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি করে পাখির মতো মারছে মানুষ। জোয়ান, তাগড়া, একটু সক্ষম কাউকে পেলে আর রক্ষা নেই। ওরা ন্যায়-অন্যায় খুঁজে না। নির্বিচারে মেরে ফেলে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সোনার ছেলে মুক্তিযোদ্ধারাও কিন্তু বসে নেই। চোরাগুপ্তা হামলা, ছোট-বড় অপারেশন তারা প্রতিদিনই চালাচ্ছে। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ আবার শত্রুর গুলিতে শহীদ হচ্ছে। তবু তারা পিছিয়ে নেই। বুকভরা সাহস আর মনভরা স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে বীরদর্পে তারা এগিয়ে চলছে।

এরই মধ্যে এনাম দু’দুটো অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছে। সফলও হয়েছে। প্রতিটি অপারেশনেই তারা পাকিস্তানি আর্মিদের তুলোধুনো করে ছেড়েছে।

অপারেশনের শুরুটা এনামই করে। চোখের পলকে সে একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে। মিলিটারিদের ক্যাম্প তছনছ করে দেয়। এভাবে একের পর এক তারা অপারেশন চালাতে থাকে।

এনাম যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে খবরটি চাপা থাকেনি। খবরটা রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কানে গিয়ে পৌঁছে। ওকে ধরার জন্য তারা ছদ্মবেশে মরিয়া হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। এ খবর এনামও জেনে যায়। তাই সেও সাবধানে চলাফেরা করে।

এদিকে যেদিন অপরাশেন থাকে না, মুক্তিযোদ্ধারা সারাদিন ক্যাম্পে বসে গল্প-গুজব করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা শোনে। এনামই দলের একমাত্র কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। তাই সে ইচ্ছে করেই সবার ফুট-ফরমাশ করে। মাঝেমধ্যে সে নানান কৌতুক পরিবেশন করে সবার মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। তাই মানুষ হিসেবে সে সবারই প্রিয়।

একদিন কিছু চা পাতা আর চিনি কিনতে কাছেই একটি দোকানে যায় এনাম। কেনাকাটা শেষ করে স্বাভাবিকভাবেই সে ফিরে আসে। কিন্তু কিছুদূর আসতেই ওঁৎ পেতে থাকা কয়েকজন লোক ওকে ঘিরে ধরে। প্রত্যেকের হাতেই চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্র দেখে এনাম বুঝতে পারে, এরা আসলে মানুষ নয়। মানুষ নামের কলঙ্ক। নরপিশাচ-নেকড়ের দল। রাজাকার বাহিনী।

এনাম বুঝল, সে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেছে। এখন কী করবে সে? কোমরে গোঁজা গ্রেনেডটাতে হাত রাখে এনাম। গ্রেনেডটা বের করা মাত্রই রাজাকারদের দুজন এসে ওকে ঝাপটে ধরে। এনাম গ্রেনেডের পিন সরাবার আগেই গ্রেনেডটা ওরা নিয়ে নেয়। রাজাকাররা কালো কাপড় দিয়ে ওর চোখ বেঁধে ফেলে। পরে পিছমোড়া করে বেঁধে হায়েনার দল ওকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

ক্যাম্পে নেয়ার পর এনামকে একটি গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। মিলিটারিরা পালাক্রমে তার ওপর অত্যাচার চালায়। ওর মুখ থেকে গোপন তথ্য বের করার জন্য এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা চালায়নি। তবু এনাম ওদের কাছে মুখ খোলেনি।

নির্যাতনে অসুস্থ এনাম ভাবে, কিছুতেই সে ওদের কাছে মুখ খুলবে না। সে যদি মুখ খোলে তাহলে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। মিলিটারিরা ওদেরও ধরে ফেলবে। কিন্তু ওদের ধরে ফেললে তো চলবে না। ওদের রণক্ষেত্রে থাকা দরকার। নইলে যুদ্ধ করবে কে? দেশটা স্বাধীন করবে কে? নিজের জীবনের চেয়ে দেশের স্বাধীনতা যে অনেক বড়।

এনাম স্থির করে, প্রাণ গেলেও সে মিলিটারিদের কাছে মুখ খুলবে না। সে চায়, দেশটা স্বাধীন হোক। শত্রুমুক্ত হোক। দেশের স্বাধীনতার কথা ভেবে মিলিটারিদের অবশিষ্ট সব রকম অত্যাচারই সে নীরবে দাঁত কিড়মিড় করে সহ্য করে যায়।

এদিকে শত নির্যাতনের পরও এনাম মুখ খুলছে না দেখে পাকিস্তানি আর্মির মেজর খুবই রাগান্বিত হয়। মেজরের যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এনামের ওপর খুবই বিরক্ত হয় বেচারা। পরে মিলিটারিরা মুমূর্ষু এনামকে জলপাই রঙের একটি জিপের পেছনে নিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। তারপর জিপ চালিয়ে ধুলো উড়িয়ে উল্লাস করতে করতে তাকে সোজা সিলেট শহরে নিয়ে আসে।

ততক্ষণে এনাম আর জীবিত নেই। জীবিত থাকার কথাও না। ওর বুকের রক্তে গায়ের সবুজ রঙের শার্টটি ভিজে যায়।

নিজের জীবন দিয়ে এনাম যেন জাতির জন্য ইনাম হিসেবে রেখে যায় একটি স্বাধীন দেশ। স্বাধীন পতাকা। সবুজের বুকে লাল সূর্য।