নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এ চিঠিটি এসে পৌঁছায়।

এটা আদৌ নূর হোসেনের কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে এই চিঠিতে সাত খুনের ঘটনার জন্য ইতোমধ্যে গ্রেফতারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া চাকরিচ্যুত র‌্যাব কর্মকর্তা মেজর সেনাবাহিনীর আরিফ হোসেন ও নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এম এম রানাকে দোষারোপ করা হয়েছে।

চিঠিতে প্রেরকের ঠিকানা হিসেবে ইংরেজিতে সুব্রত পোদ্দার, লিলিপোট ফ্যাশন হাউজ, ১২/এ, মারকুইজ স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০১৬, ইনডিয়া লেখা রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি হালিম আজাদ চিঠির সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, চিঠিটি আদৌ নূর হোসেনের কিনা সেটা আমরা নিশ্চিত না। বিষয়টি পুলিশকে জানান হয়েছে। এটা যাচাই করা উচিত।

এদিকে এই চিঠিটি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে তোলপাড় হচ্ছে। কেউ কেউ এ চিঠি নূর হোসেনের বলে বিশ্বাস করলেও বেশির ভাগ মানুষই মনে করছেন চিঠিটি নারায়ণগঞ্জের কেউ লিখে ভারত থেকে পোস্ট করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা মনে করে এ চিঠিতে র‌্যাবকে দায়ী করে যেমন লেখা হয়েছে ঠিক তেমনি নিজেকে জড়িয়ে নূর হোসেনের বক্তব্য রয়েছে। এতেই বুঝা যায়, এ চিঠিটি নূর হোসেনের পক্ষ থেকে আসেনি।

নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে আসা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

তারিখ ৩১/০৫/২০১৪ ইং

প্রিয় নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জবাসী,

আমার সালাম নিবেন। আমি লেখাপড়া না জানা একজন সাধারণ মানুষ। আমার চাওয়ার চেয়ে পাওয়াটা ছিল অত্যন্ত বেশি। তাই অহমিকা ও মূর্খতার কারণে আজ এ পরিস্থিতি। সিদ্ধিরগঞ্জ হারিয়েছে সাতটি তাজা প্রাণ। আর আমি হয়েছি দেশছাড়া। আপনারা নিশ্চই অবগত আছেন নজরুল ইসলাম সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হতে শুরু করে বহুদিন যাবৎ আমার সকল কাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধীতা করে আসছিল। তখন থেকেই সে আমার প্রকাশ্য শত্রুতে পরিণত হয়। সে আমাকে হত্যার জন্য একবার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়া গুলি করায়। আমি মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যাই। তদুপরি সে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতেই থাকে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সাথে আমার সম্পর্ক তেমন ভালো না থাকার সুযোগে গত কিছুদিন যাবৎ আমার প্রতিবেশী নজরুল ও মনির নিহত নজরুলের সহযোগিতায় আমাকে হত্যা করার উদ্দেশে ঢাকার একটি কিলার গ্রুপ এর সাথে এক কোটি টাকা চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক আমাকে যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের ওপরে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে। আমি বিষয়টি টের পাইয়া প্রাণে রক্ষা পাই। পূর্বেও তারা আমাকে হত্যার জন্য অপহরণ করে। আমি সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে রক্ষা পাই। নজরুল ইসলামের সাথে তৎকালীন সাংসদ কায়সার হাসনাত, সিটি মেয়র আইভী, এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর সাথে সুসম্পর্ক থাকায় নজরুল চিটাগাং রোডে সড়ক ও জনপথের অফিসে, পাওয়ার হাইজ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আদমজী ইপিজেড, চিটাগাং রোড ট্রাক টার্মিনাল এবং সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কাজ এককভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তাছাড়াও আমার ব্যক্তিগত বিভিন্ন ব্যবসায় বিভিন্নভাবে বাধা ও হয়রানি করতে থাকে। এমনকি আমার প্রাণনাশেরও চেষ্টা করিতে থাকায় আমি নিরুপায় হয়ে বিষয়টি বড় ভাইকে জানাই। তিনি আমাকে তাকে পথ থেকে সড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। আমি বিষয়টি নিয়ে মেজর আরিফের সাথে কথা বলিলে তিনি আমার থেকে বড় ভাইয়ের সম্মতি আছে কিনা জানতে চান। আমি হা বলিলে তিনি বড় ভাই এর সাথে কথা বলে আমাকে জানাবেন বলে জানান। আমি মেজর আরিফকে নিয়ে একদিন রাতে বড় ভাইয়ের কাছে গেলে তিনি সম্মতি দেন এবং ইসমাইলের বিষয়েও কথা বলেন। ইসমাইলের বিষয়ে মতি আমার মাধ্যমে ৫০ লক্ষ টাকা দেন। ইসমাইলের কাজটি সমাধানের পর নজরুলের কাজটা নিয়ে মেজর আরিফ ও রানা, তারেক সাহেবের সাথে কথা বলে ১ কোটি দাবি করলে আমরা সম্মত হই। ১৫/২০ দিন পর মেজর আরিফ আবার আমার কাছে ২ কোটি টাকা দাবি করে বলেন তাকে একা পাওয়া যাবে না। দুইজনকে কাজ (মানে হত্যা) করতে হবে। উপরে ১ কোটি টাকা লাগবে, তাই মোট দুই কোটি টাকা লাগবে। আমি বড় ভাইকে বিষয়টি জানাইলে তিনি আমাকে এক কোটি, মতিকে ৫০ লক্ষ আর ইয়াসিনকে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে বলেন। বিনিময়ে আমাকে বালু ও ট্রাক স্ট্যান্ড, ইয়াসিনকে সড়ক জনপথ ও পাওয়ার হাউজ আর মতিকে ইপিজেড ও তেলের ডিপো এবং মজিবর রহমানসহ অন্যান্যদের জন্য ইজারাকৃত বিভিন্ন পার্কিং টোল ভাগাভাগি করিয়া দেন। মজিবর ভাইকে আমাদের সবকিছু সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেন। কাজটি করার জন্য নজরুলের গতিবিধি দেখাশুনার জন্য আমাকে ও মতিকে দায়িত্ব দেন মেজর আরিফ। একবার যাত্রাবাড়ি, একবার সাইনবোর্ড ও আরেকবার মিজমিজি এলাকায় কাজের (হত্যার) পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা নিরাশ হই। এরপর বড় ভাই আমাকে জানায় ২৭ তারিখে সে কোর্টে আসিবে এবং কোর্ট থেকে বাহির হইলে যেন কাজটি করি। সেই মোতাবেক আমি আরিফ সাহেবকে বলিলে আরিফ সাহেব তার দলবল নিয়া দশজন এই কাজে রওনা হন এবং কোর্ট এলাকায় দুইজন সোর্স নিযুক্ত করেন। মতিও তার সোর্স পাঠিয়ে নজরুলের কোর্টে থাকা নিশ্চিত ও তাকে সনাক্ত করানোর কাজটা করান। আমি ও র‌্যাব এর সাথে থাকা আমার লোক শাহজাহানের মাধ্যমে র‌্যাব এর কাজকর্ম তদারকি করি। বেলা ১:৪৫ টায় র‌্যাবের সদস্যরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। পরে জানতে পারলাম মোট সাতজনকে র‌্যাব উঠিয়ে আনে। র‌্যাব পরিস্থিতি বুঝেশুনে কাজ করার জন্য তাদেরকে অজ্ঞান করে তাদের হেফাজতে রাখেন। এরপর একই দিন রাত ২টা ৩০ মিনিটে তাদের হত্যা করা হয় বলে আরিফ ও রানা আমাকে জানায়। আমি সাতজন হত্যা হোক এটা কখনও চাইনি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এ কাজটা তারা করেন। এ কারণে আমি বড় ভাইকে বলি এত বড় কাজটি আমি করিনি। কি কারণে কার নির্দেশে র‌্যাব এত বড় কাজটি করল তা আমার জানা নেই। এরপর আমি বড় ভাইয়ের নির্দেশে ভারতে চলে আসি। নারায়ণগঞ্জবাসীর জানা একান্ত প্রয়োজন মনে করে এই ঘটনাটি আমি জানাইলাম। কারণ আমাকে যে কোন সময় হত্যা করিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুরো ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জবাসীর নিকট অজানা থাকিয়া যাইবে আর বিনা দোষে অনেকে শাস্তিভোগ করিবে। আমার এই কাজের কোনো ক্ষমা নাই তবুও আমি নারায়ণগঞ্জবাসী তথা সিদ্ধিরগঞ্জবাসীর নিকট ক্ষমা প্রার্থী।

ইতি

নূর হোসেন