প্রবীর সিকদার


 

বাবাকে বাবা ডাকতে পারিনি এই বাংলাদেশের জন্য। শুধু কি বাবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে উৎসর্গ করেছি দাদু, কাকা, মামাসহ কতো স্বজন! সেই একাত্তরে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছি, আজো আমি উদ্বাস্তু। আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে করেছি পড়াশোনা। জীবন চলার পথে সঙ্গী করেছি একাত্তরে আমার মতোই বাবা হারানো এক মেয়েকে।

একাত্তরে বাবা নিখোঁজ হলেও সেই সময় তার মৃত্যু সংবাদ পাইনি। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর খুন হওয়ার সংবাদটিই আমার বাবার প্রথম মৃত্যু সংবাদ বলেই জেনেছি। আমি বুকে লালন করি একটি মাত্র স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেই স্বপ্ন বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছি আমার সাধ্যের বৃত্তে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের একাত্তরের কুকীর্তি নিয়ে লিখেছি সংবাদপত্রের পাতায়। একাত্তরের হায়েনারা বোমা, গুলি, চাপাতি চালিয়ে আমাকে খুন পর্যন্ত করেছে! ঘাতক চক্র মৃত্যু নিশ্চিত করে আমাকে রাস্তায় ফেলে গেলেও সাধারণ মানুষ দেহে প্রাণের সঞ্চার আবিস্কার করে আমার রক্তাক্ত দেহ নিয়ে গেছেন হাসপাতালে। তারপর আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও দৈনিক জনকণ্ঠ কতৃপক্ষ। কয়েক দফায় দেশে বিদেশে চিকিৎসায় আমি জীবন ফেরত পেলেও আমাকে চিরদিনের জন্য হারাতে হয়েছে একটি পা; হারাতে হয়েছে একটি হাতের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। শরীরে রয়ে যায় বোমার অসংখ্য স্প্লিনটার; যা আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত যন্ত্রণা দিবে।

তারপরও আমি কৃত্রিম পায়ে ভর করে চালাই জীবনযুদ্ধ; সেই সাথে চলে আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লড়াই। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার স্পষ্ট অবস্থান সত্যের পক্ষে থাকা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে গত বছর ক্ষমতার দাপটে অন্ধরা আমাকে কথিত মামলায় জড়িয়ে থানা পুলিশ ব্যবহার করিয়ে নির্যাতন করেছে, কারাগারে ঢুকিয়েছে। সারা দেশের মানুষের তীব্র প্রতিবাদ ও বিদেশের নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় মুখে আমি মুক্তির স্বাদও পেয়েছি।

এখন আমি নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করি, আমি আসলে কে? স্বাধীনতার বেদিমূলে সকল স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কি পেলাম! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার জন্য কাজ করতে গিয়ে অর্ধেক শরীর হারালাম! তার প্রতিদান হিসেবে পেলাম পুলিশী নির্যাতন ও কারাগারের বাসিন্দা হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ! ক্ষমতা ভোগ করা মানুষগুলো কি একবার খোঁজ নিয়েছেন, অর্ধেক শরীর নিয়ে কেমন আছে মৃত্যুর দরজা থেকে ফেরত আসা সেই সাংবাদিক প্রবীর সিকদার! সাত বছর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়, সরকার বা তাদের কেউ আমার কোনো খোঁজ নিয়েছেন! বরং আমাকে শায়েস্তা করতে পুলিশ ব্যবহার করা হয়েছে, ঢোকানো হয়েছে কারাগারে! আমি বুঝি, আমি এমন কেউ নই যে, আমার খোঁজ নিতেই হবে! তার মানে কি এই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মুক্তিযুদ্ধের দর্শন; সেই দর্শনের পক্ষে অবিচল থাকায় আমাকে পুলিশী নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে, ঢুকতে হবে কারাগারে! মামলায় পর্যুদস্ত হয়ে ভুলে যাবো বঙ্গবন্ধু তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-দর্শন!

অবশ্য আমি এখন সকল অন্যায় আচরণের মুখে পড়বার জন্য তৈরি, দেখি কে কতোটা নিচে নামতে পারেন! হার না মানা বঙ্গবন্ধুর দর্শন আমার পাথেয়।