সিরাজ প্রামাণিক, কুষ্টিয়া : আর দশজন সাধারণ মানুষের চেয়ে চিন্তা-চেতনায় ভিন্ন এক মহান মানুষ বাবু ডিজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। যখন তিনি নিজের ভাবনার সঙ্গে বাস্তবকে মেলাতে পারেন না, তখন তিনি বেদনায় মুচড়ে পড়েন। আত্মহননও হানা দেয় তাঁর মনের কোঠায়। বড় স্পর্শকাতর মন তাঁর। চিন্তা চেতনায় সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ তিনি। তিনি আপাদমস্তক বিজ্ঞানমনষ্ক।

ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। বড় বড় চাকুরীর প্রস্তাব পেয়েছেন। সবকিছু ছেড়ে যৌবনে মন দিয়েছিলেন নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার খোকসায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া নিজের জমি বিক্রি করে আর এলাকার যুবকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন খোকসা কলেজ। এ খোকসাকেই তিনি ঢাকা বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে এলাকাবাসীর বক্তব্য খোকসা ঢাকা না হলেও খোকসবাসীকে ঢাকা যেতে ও বড় বড় চেয়ারে বসতে শিখিয়েছেন মহৎ মনের মানুষ বাবু ডিজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। তার প্রতিষ্ঠিত কলেজেই তিনি শিক্ষতার চাকুরী নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষের দিনগুলো তাঁর ভাল যায়নি। নতুন নতুন মহারথিরা তাঁর অবদান অস্বীকার করে খালি হাতে বাড়ি পাঠিয়েছেন। তাতে তাঁর মনে কোন দুঃখও নেই। তিনি আকাশ, নদী, ফুল পাখির মত উদার।

তিনি মানব মুক্তির নতুন নতুন দর্শন নিয়ে এখনও লিখে চলেছেন। রয়েছে কয়েক হাজার সনেট। আর্থিক দৈন্যতা আর উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে কোন কিছুই আলোর মুখ দেখেনি। একজন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এ মানুষকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর নিজ মাতুলালয়ে। জীবন সায়াহ্নে এসে চরম অবহেলা, অনাদার আর কষ্টের মধ্যে রয়েছেন এ মহান মানুষটি। চোখে ভাল দেখে না-একটু চোখের চিকিৎসা করার আকুতি জানান। পড়ে গিয়ে দাঁতগুলো ভেঙ্গে যাওয়ার কথা জানালেন। জানালেন কোমরের একটা হাড় সরে যাওয়ায় হাঁটা চলা ফেরার অসুবিধার কথা। কিন্তু তাঁর জীবনের কোন অপূর্ণতার কথা তিনি জানালেন না।

হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়, সব মানুষের জীবনেই অপূর্ণতা থাকে। অতি পরিপূর্ণ যে মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে ও অতি দুঃখের সঙ্গে তার অপূর্ণতার কথা জানাবেন। অপূর্ণতা থাকে না শুধু বড় বড় সাধক ও মহাপুরুষদের। খোকসার জীবন্ত জ্ঞানকোষ বাবু ডিজেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের বেলায়ও একথা প্রযোজ্য। যাঁর মধ্যে এখনও লুকিয়ে রয়েছে শত শত ঘুমন্ত বই, জেগে থাকা এক প্রাণবন্ত মানুষ, যাঁর জীবন ও আদর্শ এক একটি মহাগ্রন্থ। জীবন সায়াহ্নে এসে চরম অবহেলা, অনাদার আর কষ্টের কথা জানিয়ে দিতে চান তার প্রিয় ছাত্রদের মাঝে। আমরা কি পারি না এই ফুলের মতো মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তার অনুযোগ-অভিযোগ শুনে সমাধান দিতে? আসুন এ জীবন্ত জ্ঞানকোষকে পুনরায় সমাজের মাঝে ফিরিয়ে এনে নতুন সমাজ গড়ে তুলি।

(এসপি/এএস/সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬)